ভালবাসা মানে বিশ্বাস, ভালোবাসা মানে সাহস। ভালোবাসা মানে ভয় ভেঙে বাধা পেরিয়ে কাছে আসার। আর সেই সব কাছে আসার গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে " কাছে আসার গল্প " ব্লগ সাইটি।☞হাজারো 'কাছে আসার গল্প' শুনতে আমাদের সাথেই থাকুন সব সময়।

Search

Latest update

Banner

21/09/2018

কাছে আসার গল্প: রৌদ্রজ্জ্বল রাত্রি



গল্প: রৌদ্রজ্জ্বল রাত্রি # লেখক ইমরান

# (১ম পর্ব)

"পৃথিবীতে দুই ধরনের ভালো মেয়ে আছে। ১. যারা এখনও জন্মে নি। আর, ২. যারা মরে গেছে।" এই গূঢ় সত্য কথাটা কে বলেছেন, তা ঠিক জানি। খাঁটি কথা বটে। তবে এই কাজের মেয়েটা খুব ভালো। অসাধারণ রান্নার হাত, মাথা বানাতে পারে, হাত-পাও মালিশ করে দিবে। যখন যেকাজটা করতে বলবেন, সেকাজটাই করবে। খাবে না, ঘুমাবেও না। এমন মেয়ে পাওয়া যায় না।
শহীদুল ইসলাম এই বলে থামলেন। জহির সাহেবের অনুমতির অপেক্ষায় আছেন। জহির সাহেব অনুমতি দেবার আগে মেয়েটার দিকে একবার তাকালেন। মেয়ে বেশ ফর্সা। তারমানে সুন্দরী! বাঙলাদেশে ফর্সা হলেই কোনও মেয়েকে সুন্দরী বলা হয়। সৌন্দর্যের মাপকাঠি-টা ঠিক কিসের সাথে তুলনা করে মাপা হয়, তা আমার জানা নেই। কালো একটা রঙের নাম, অথচ অর্ধশিক্ষিত মানুষের মনস্তত্ত্বে "কালো" সারাজীবন একটা ঘৃণার নামই লেখা হয়ে আছে। মেয়েটার চোখেমুখের চাহনি বেশী উৎসাহব্যঞ্জক। যেকোনো কাজ সে করতে পারবে, এমন ভাবটাই চোখেমুখে ভেসে বেড়াচ্ছে। জহির সাহেব ইতস্ততভাবে বললেন, মাসিক সেলারি?
শহীদুল ইসলাম হাসলেন। যেন এই ধরনের মেয়ে পেলে মাসিক সেলারি কোনও বিষয়ই না! 'মাত্র ৬ হাজার টাকা!'
জহির সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। বাসায় তিনি একা। তার জন্য রান্না, ঘর পরিষ্কার করার জন্য ছয় হাজার টাকা খরচ করাটা বাতুলতা। তবুও তিনি রাজি হলেন।
শহীদুল ইসলামের ঠোঁট কিছুটা প্রশস্ত হলো। আমরা যে আসলে নিজেদের জন্যই হাসি -এব্যাপারে সত্যতা পাওয়া গেল। তিনি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
কি সমস্যা?


২.পর্ব


মেয়েটাকে জহির সাহেব বাসায় নিয়ে এলেন। মেয়েটাকে দ্যাখলে কাজের মেয়ের মতন মনে হয় না। খুব সম্ভব পড়াশুনা জানা মেয়ে, কেন কাজ করতে এসেছে; তাও জানতে হবে। তবে একদিনে সব জেনে নেয়াটা ঠিক হবে না। বেশী চাপ দিলে যেকোনো কিছুই ভেঙে যায়। তিনি হাসিমুখে বললেন, মা, তোমার নাম কি?
মেয়েটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আগেও একবার বলেছি।
ভুলে গেছি।
তৃষাণা।
ও হ্যাঁ, মনে এসেছে। আগে-পিছে কিছু নেই?
আগে-পিছে কিছু না থাকলে কি কোনও সমস্যা হয়?
জহির সাহেব চুপসে গেলেন। এই চুপসে যাওয়াটা আনন্দের। মেয়েটা কাজের মেয়ে হলেও তার আচরণ দ্যাখে মনে হচ্ছে, এই মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে অবসরে। তার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ব্যক্তিত্ব আছে, বেশিরভাগ কাজের মেয়ের মধ্যেই এটা থাকে না। এটা থাকা উচিত। ব্যক্তিত্ব শুধুমাত্র বড়লোকদের সম্পত্তি না, গরীবদেরও সম্পদ।
মেয়েটার হাতের রান্না অসাধারণ!

প্রথম দিন অবশ্য সবাই তার সেরাটা দিয়ে থাকে, এরপর থেকে আস্তে আস্তে মন্দ হয়ে যায়। তবে জহির সাহেবের খাওয়া নিয়ে গুরুতর কোনও অভিযোগ থাকে না। তার স্ত্রী এসব তুচ্ছ ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস ছিল। তিনি অফিসে কাজ করছেন এমন সময়ে স্ত্রী ফোন করে বলত, খাইছো তুমি? জহির সাহেব কোনও মিটিঙে আছেন, মিটিঙে ঢোকার আগেই তিনি স্ত্রীকে ফোন করতে মানা করে দিয়েছেন। কিন্তু সহজাত চাপা বুদ্ধির জন্য স্ত্রী ফোন করে বলে, খাইছো তুমি?

 দুপুরে কি রান্না হয়েছে জানো...?

জহির সাহেব প্রচণ্ড বিরক্ত হোন। রেগেমেগে বলেন, নারীজাতি খাদ্য ব্যতীত অন্যকিছু চিনলো না বিধায়ই, পুরুষ জাতি তাদেরকে আজীবন রান্নাঘরে বন্দী করে রেখেছে। স্ত্রী একথায় দারুণরকম অপমানিতবোধ করেছিলেন। তিনদিন চুলো জ্বলে নি সেবার। জহির সাহেব তাতে মনঃক্ষুন্ন হোন নি।
তার মতে, খাবার তো ডাস্টবিনেই পাওয়া যায়, খেতে চাইলে ময়লাও ভক্ষণ করা যায়। কোনও মানুষ যদি সেটা না পারে, তবে দোষটা তার মুখরুচির, খাদ্যের নয়।

জহির সাহেবের পাশে তৃষাণা দাঁড়িয়ে আছে। সে খাবে না। তার বোধহয় খাবারের কোনও প্রয়োজন নেই। তিনি মেয়েটার রান্নার মুখ ভর্তি প্রশংসা করলেও সে নিশ্চুপ ছিল। ভাবখানা এমন যে, সামান্য ব্যাপারে অত ইমোশন দ্যাখাতে নেই। সামান্য ইমোশনে মানুষ সুইসাইড করে, রাগ করে দূরে চলে যেতে যেতে কাছে ফিরে আসে, কাছে আসতে আসতে আর কখনওই ফিরে আসে না। মানুষের জীবনে সামান্য'র প্রয়োজন অসামান্য।
রাত তিনটা। জহির সাহেবের ঘুম আসছে না।

রাতে তার ঘুম কম হয়, তবুও তিনি বিছানায় পড়ে থাকেন ঘুমের অপেক্ষায়, যেভাবে একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য পার্কে অপেক্ষা করে। সব ঘুম কি বিছানায় আসে? সব ঘুম কি কবরে চলে যায় মৃতার কাছে? সব ঘুম কি ছেলেটার কাঁধে এসে মেয়েটার চোখে জড়ায়?
সব ঘুম, এত ঘুম কেন আসে এই পৃথিবীতে...? অন্যগ্রহের প্রাণীদের ঘুমের কোনও প্রয়োজন নেই। তাই তারা কাজ করার সময় বেশী পায়। মানুষ এমনিতেই অলস, ঘুম অলসতার ফসল, মানুষ সেখানে চাষাবাদ করে, বিছানাটা বিস্তৃত জমিন। তিনি হাঁটি হাঁটি পায়ে তৃষাণার রুমে এলেন। মেয়েটা একটা বই পড়ছে। তিনি খুব খুশি হলেন। আজকালকার 'তথাকথিত' শিক্ষিত মানুষরা বই পড়ে না। তিনি মেয়েটার পাশে বসলেন। আদর করে বললেন, তুমি ঘুমাও নি?

মেয়েটা ভূত দ্যাখার মতন চমকে গেল। অবাক হয়ে বলল, আমি তো ঘুমাই না।
ও আচ্ছা। কি করছো?

মেয়েটা জবাব দিল না। তার বোধহয় ইচ্ছে ছিল বলবার, নিজের কাজ করছি, আপনিও আপনার কাজ করুন। কিন্তু কি ভেবে আর বললো না। খুব সম্ভব, যে মানুষটাকে আমরা বই পড়তে দ্যাখছি, তাকে 'কি করছো?' বলাটা অপ্রাসঙ্গিক। জহির সাহেব দ্যাখলেন তৃষাণার হাতে 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' বইটা। হাসিমুখে বললেন, বইটার কতটুকু পড়েছো?
৫৩ পৃষ্ঠা।
কেমন লাগছে?
তরল!
মানে?
মানে বোঝাতে পারব না।
আচ্ছা। দুরদানাকে কেমন লেগেছে?
ছেলে, কিন্তু ভুলবশত মেয়ে হয়ে গেছে।

জহির সাহেব হাসলেন। দুরদানা খুবই সাহসী নারী চরিত্র। নারীরা বেশী সাহসী হয়ে গেলে তাদেরকে পুরুষদের সাথে তুলনা দেয়া হয়। এটা ঠিক না, মেয়েদেরকে 'মেয়ে' হিশেবে না দ্যাখে মানুষ হিশেবে দ্যাখা উচিত। জহির সাহেব বললেন, পুনঃজন্ম যদি মিথ্যে নাহয়, তাহলে তোমার কথা অর্ধেক সত্য। আসলে দশবছর অন্তর কিছু-না-কিছু মানুষের জন্ম হয়, যারা পৃথিবীর ভিন্ন স্রোতে হাঁটে। হয়তো তারা না, আমরাই ভিন্ন স্রোতে হাঁটি। ব্যতিক্রমের সংজ্ঞা কি? আমি ব্যতিক্রম তারমানে কি আমি সবার থেকে আলাদা? নাকি অন্য সবাই-ই আমার থেকে আলাদা?

আপনার কথায় সামান্য লজিক আছে। তবে সম্পূর্ণটা দর্শনের আওতায় পড়ে। আমি আলাদা, আর সবাই আমাদের থেকে আলাদা -দুটাই কিন্তু ঘুরেফিরে একই জিনিশ।

তা ঠিক। কিন্তু তুমি যখন ভাবতে থাকবে, তুমি সবার থেকে আলাদা, তখন তোমার ভেতর একধরণের হীনমন্যতার সৃষ্টি হবে। মানুষ সবাইকে ছাড়া বাঁচতে পারলেও 'নিজেকে' ছাড়া বাঁচতে পারে না। অথচ এই মানুষই নিজের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে চায় না।
তৃষাণা বলল, আপনি চান তো?
বাধ্য হয়ে চাই। আমি একা মানুষ।
তৃষাণা হালকা এই প্রথম হাসলো। 'মানুষের এই এত এত সাধগুলো আমাকে সত্যিই আনন্দ দেয়। মানুষ আয়োজন প্রিয়। একটা লাশকেও তারা আয়োজন করে দাফন করে, কতজন দ্যাখতে আসে, চোখ ভেজায়। এত আবেগ তারা কিভাবে ধারণ করে -জানি না। '
তৃষাণা?
জি।
তুমি কি খুব বই পড়ো?
পড়ি। এই একটাই নেশা আমার। টানা মাসের পর মাস বই পড়ে কাটাই। ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করে না। ভালবাসার জন্য কখনও স্পর্শকাতর হই নি।
স্পর্শকাতর ভালবাসা কি?
তৃষাণা চিন্তায় পড়ে গেল। সে কখনও এই বিষয়টা নিয়ে ভাবে নি। আসলেই তো, 'স্পর্শকাতর ভালবাসা' কি? স্পর্শের জন্য কাতর ভালবাসার নাম স্পর্শকাতর ভালবাসা? নাকি, যতটুকু স্পর্শের জন্য একটা প্রেমিক মন কাতর হয়, ঠিক ততটুকুই ভালবাসার নাম 'স্পর্শকাতর ভালবাসা'?
৩.
জহির সাহেবের বাসায় মজিব এসেছে। এই ছেলেটাকে সবসময় পাওয়া যায় না। যখন তার দরকার হয়, তখন সে চলে আসে। অলৌকিকভাবে যখন মজিবের জহির সাহেবকে দরকার হয়, তখন জহির সাহেবেরও মজিবকে দরকার হয়। গতরাতেই তিনি মজিবকে কি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলবেন ভেবেছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর তা বেমালুম ভুলে গেলেন। মাঝেমাঝে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর তার মনে হয়, তিনি বিছানায় নেই। অন্যকোথাও পড়ে আছেন। তিনি ঘুমান নি, গতরাতে জেগেছিলেন, কেন জেগেছিলেন তাও মনে পড়ে না, মনে হয় তিনি মানুষ নন, অন্যকিছু। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পরও তার এমন হয়েছে। তার মনে হচ্ছিল, তিনি হয়তো কখনও মানুষ ছিলেন, এখন আর নেই...! এই ঘোরটা অবশ্য বেশীক্ষণ থাকে না, কেটে যায়। যখন ঘোরটা আসে তখন মনে হয় ঘোরটা থেকে তিনি মুক্তি চান। আবার যখন ঘোরটা কেটে যায়, তখন মনে হয়, তিনি এই অদ্ভুত ঘোরেই ফিরে যেতে চান। হাত-পা অবশ করে ঘুমিয়ে থাকতে চান। প্যারালাইজড হয়ে বোতল আধ-ঘুমে ঘুমিয়ে পড়তে চান।
মজিব এখন একটা ভালো চাকরি করে। তার চারটা লাশের গাড়ি আছে। লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা। ড্রাইভারও চারজন আছেন। মজিব তাদের মালিক। ভালো টাকা হাতে আসায় আরেকটা শুভকাজে নামবে। তাই জহির সাহেবের দোয়া নিতে এসেছে।
জহির সাহেব বিষণ্ণ গলায় বললেন, মেয়ের পড়াশুনা কতদূর?
মজিব পানে লাল হওয়া অথবা কৃত্রিম রক্তে রঞ্জিত হাসি হেসে বলল, মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে।
জহির সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এত ছোট মেয়ে?
ছোট কোথায়? ছোটগুলোই ভালো। মেয়ে বড় হওয়া মানে, জানোয়ারের সাথে ঘর করা। বড় মেয়ে সামলানো খুব ঝামেলা।
ছোট মেয়ে সামলাতে পারবি তুই?
আরে চাচা, আপনি মজিবকে চেনেন না। যে লাশ সামলাতে পারে, তার কাছে ছোট মেয়ে, বৌ বাচ্চা কিছুই না। তবে বড়মেয়েগুলো হাড় বজ্জাত! এগুলো সামলানো মানে সময় নষ্ট। এরা জানে, তারা ভুল করছে, কিন্তু সেটা অস্বীকার করবে।
তৃষাণা চা নিয়ে এলো। জহির সাহেব চা করতে বলেছিলেন। তাই বলে শুধু যে চা-ই নিয়ে আসবে, তা ভাবতেও পারেন নি। রাতে মেয়েটাকে এব্যাপারগুলো বোঝাতে হবে। সে যে অন্যকোথাও কাজ করে নি, তা বোঝা যাচ্ছে। তৃষাণা চলে গেল, আর কিছু লাগবে কিনা -বলে যাবারও প্রয়োজন মনে করল না।
মজিব অবাক হয়ে বলল, মেয়েটা কে? নতুন কাজের মেয়ে? কবে নিলেন চাচা?
জহির সাহেব চা-তে চুমুক দিয়ে বললেন, ও মেয়ে না।
মেয়ে না মানে?
ও একটা রোবট।


# ২য় পর্ব


মজিব বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি রোবট মেয়েকে কাজের মেয়ে করে রেখেছেন?
হ্যাঁ।
আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?
মনে হয় না।
আমার তো মনে হয়। সমাজে চলতে হলে আপনি এই বিষয়টাকে নিয়ে থাকতে পারবেন?
জহির সাহেব উত্তর না দিয়ে শান্তভাবে চা খাচ্ছেন। মজিব এখনও নূতন একটা ব্যাপারকে সহজভাবে নিতে পারছে না। সে যা বলছে তা সমাজের কথা, তার নিজের কথা না। সুতরাং তার উপরও রাগ করা যাচ্ছে না। সে এখন একজন সমাজের একজন সচেতন প্রতিনিধি। যে চায়, সমাজে বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে নিয়ে বাঁচতে হবে, রোবটকে নিয়ে নয়। এটা উন্নত কোনও দেশ নয়। তৃতীয় বিশ্বের একটা গরীব দেশ। এখানে প্রচুর মানুষ বেকার থেকে আত্মহত্যা করছে, সেখানে জহির সাহেব কোনও বেকার মেয়েকে বাসায় এনে চাকরি দিয়ে বেকারত্ব দূর করতে পারতেন, তিনি তা না করে সামান্য দেশদ্রোহিতা করেছেন। এর জন্য তার শাস্তি হওয়া আবশ্যক। মজিব চায়ে হালকা চুমুক দিয়ে বললেন, চাচা!
জি?
এটা কিন্তু ঠিক করলেন না। কত মানুষ দেশে না খেয়ে মরতেছে, কত মেয়ে কাজ পায় না। সেখানে যদি আপনি এই রোবট ট্র্যান্ডটা চালু করেন তখন সবাইই তাদের বাসায় কাজের মেয়ে হিশেবে রোবট-কেই বেঁচে নিবে। বাঙলাদেশের বেকারত্বের হার কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছেন?
জহির কিছু না বলে মাথা নাড়লেন। ভাবখানা এমন- তা তিনি বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু তা অস্বীকারও করছেন।
চাচা।
জি?
সময় থাকতে একে বিদায় করেন। নইলে পরে না পারবেন রাখতে, না পারবেন ছাড়তে। আগেভাগেই বলে দিলাম। আপনার যদি জেলও হয়, তখনও কিছু করার থাকবে না। আপনি কাজের রোবট নিয়ে সংসার করবেন, মানুষকে বলবেন কাজের মেয়ে; তা তো হয় না। মানুষ কি বলবে? আপনি একা মানুষ। সে বাসায় রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা একটা কাজের মেয়ে থাকে। কেও এটা সহজভাবে নিবে? কেওই নিবে না। সবাই তখন বলবে, বুড়াকালে যৌন বিকৃতি ঘটছে। চললাম। স্লামালাইকুম!
জহির সাহেবের চিন্তায় পড়ে যাবার কথা ছিল, তিনি গড়পড়তার কথা না রেখে দুশ্চিন্তা মুক্ত আছেন। রেভ্যুলেশন বাসা থেকেই শুরু করতে হয়। নূতনত্বে মানুষের অভ্যাস নেই বলে মানুষ এখনও রোবটদের প্রাপ্ত সম্মান দিচ্ছে না। মানুষ অভ্যাসের দাষ, আবার কোথাও কোথাও অভ্যাসই মানুষের দাষ। সৌন্দর্যের পূজো করা মানুষগুলো কি জানে, সৌন্দর্যই প্রতিনিয়ত মানুষকে পূজো করে যাচ্ছে...?
জহির সাহেব নিজের রুমে এসে বসলেন। তার স্ত্রীর ছবিটা দেয়ালে সাঁটানো আছে। স্ত্রীকে তিনি ভালবাসতেন কিনা, তা নিজেই জানেন না। তবে তার স্ত্রী তাকে অসম্ভব ভালবাসতেন। ''অসম্ভব ভালবাসা" বলতে মানুষ অতিরিক্ত ভালবাসা বোঝে। এটাও একটা অসম্ভব ঝামেলা। তারমানে মানুষ ধরেই নেয় যে, বর্তমান যুগে অতিরিক্ত ভালবাসা এক প্রকারের অসম্ভব ঘটনা...? তিনি মাঝে মাঝে রাতে না খেয়ে ঘুমাতেন। তার শরীর এনিয়ে আপত্তি না করলেও তার স্ত্রী ঘোরতর আপত্তি করত। তিনি অসহ্য বিরক্ত হতেন। প্রায়ই ভাবতেন, মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে একাকী থাকবেন। কিন্তু কোথায় যেন একটা বাঁধা ছিল। কোথায় এসে যেন থমকে যেতেন, পিছু ফিরতেন, মনে হতো কিছু ফেলে এসেছেন। তা কুড়িয়ে নিতে এলেই আবার সেই আগের অশান্তি। তার মনে হতো, এভাবে বাঁচা দায়! এভাবে কেও বাঁচতে পারে না। যদি কেও পারে, সে হয়তো পশু, নয়তো দেবতা। তার স্ত্রীর মধ্যে একটা শক্তি ছিল। মেয়েটা ছোটবেলা থেকে এতিমখানায় বড় হয়েছে, তবুও তার মধ্যে কষ্টের কোনও রেশ নেই। যেন- এতিম হয়ে বড় হওয়াটা একটা গৌরবের ব্যাপার। মাঝেমাঝেই রাতে ঘুম থেকে উঠে মেয়েটা বলত, চলো গল্প করি। জহির সাহেব প্রচণ্ড বিরক্ত হতেন। তার সকালে অফিস থাকে। রাতে ঘুমানো ছেলেদের জন্য আবশ্যক। আবশ্যক ব্যাপারগুলোতে রোমান্টিকতা থাকে না। মেয়েদের মধ্যে সেটা থাকে। এই পৃথিবীতে ঈশ্বরের সরাসরি দ্যাখা পাওয়া যেমন অসম্ভব ব্যাপার, তেমনি বুদ্ধিমতি নারীর দ্যাখা পাওয়াও অসম্ভব একটা ব্যাপার। একবার জহির সাহেবের অনেক জ্বর হলো। প্রাণ যায় প্রাণ যায় -অবস্থা। স্ত্রীকে তিনি ডাক্তার ডাকতে বললেন, স্ত্রী ডেকে আনলেন এক নামজাদা প্রসিদ্ধ কবিরাজকে। সে যাত্রায় কোনওমতে বেঁচে ফিরেছিলেন তিনি। স্ত্রীকে ধমক দিয়েও তার ব্যক্তিগত অতীত কুসংস্কার থেকে তাকে মুক্ত করতে পারেন নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর খুব একটা কষ্ট পান নি তিনি। লাশ দাফন করার পর আর কখনও কবর জিয়ারত করতে যান নি, তিনি এসব ব্যাপারে অবিশ্বাসী।

জহির সাহেব তৃষাণার রুমে এসে দ্যাখলেন, সে বসে আছে। কোনও জিনিশ চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। এই সময় তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে কিনা, বুঝতে পারছেন না। রোবটরা বিরক্ত হয় বলেও মনে হয় না। তিনি তৃষাণার পাশে এসে বসলেন। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। মেয়েটা যথেষ্ট রূপসী। বয়স কত তা বোঝা যায় না। মানুষ হলে নিশ্চয়ই একুশ হতো। বুড়ো বয়সে কোনও মেয়েকে দ্যাখলে নিজের মেয়ের মতো করে ভাবতে ভালো লাগে, আর তরুণ বয়সে দ্যাখলে সম্পর্কটা দাঁড়াতো নিজের স্ত্রী বা প্রেমিকা। এর বাহিরে কিছু ভাবা যায় না। কারণ সামাজিক নিয়ম, এই সামাজিক নিয়মটা ঠিক কিসের সাথে ভিত্তি করে বানানো হয়েছে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি খুব নরম করে বললেন, তৃষাণা!
তৃষাণা জবাব দিল না।
তুমি কি শুনতে পাও নি?
পেয়েছি।
তাহলে কথা বলছো না কেন?
প্রশ্ন করলেই কি উত্তর দিতে হবে? এটা কি আপনারা মানুষরা তৈরি করেছেন? রোবটা সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ব্যাপারটা নেই, যে চাইবে উত্তর দিবে, যে চাইবে না, সে দিবে না।
রোবটদেরও কি ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে?
অবশ্যই আছে। তবে সামান্য। আমরা মানুষের কথামতো চলি ঠিক, কিন্তু আমাদেরও একটা আলাদা চিন্তা-জগত থাকে, যেখানে আমরা বাস করতে ভালবাসি। এই যে আমি চিন্তা করছি, আপনি পাশে বসে থেকে যদি বকবকও করে যান, তাহলেও আমার চিন্তায় ব্যাঘাত হবে না। কারণ আমাদের মনস্তত্ত্ব নেই, যার কারণে আমাদের প্রত্যেক অঙ্গে থাকে মস্তিষ্ক। এই কারণে আমাদের চিন্তাশক্তি প্রখর হয়। কোনও মানুষের মধ্যে যদি ভালোবাসা, দয়া-মায়া না থাকে তাহলে মানুষরা তার নাম দেয় 'রোবট', কেন দেয়? কারণ তার হৃৎপিন্ডের উপর একটা মস্তিষ্ক অবস্থান করে। অই মস্তিষ্ক-টাই তাকে চালায়, যার ফলে সে আমাদের শ্রেণীর লজিক্যালী চিন্তায় অগ্রসর হয়।
জহির সাহেব ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, তুমি কি চিন্তা করছো?
ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে হালকা চিন্তা করলাম।
কি জবাব পেলে?
তেমন কিছুই না, সময় নষ্ট মনে হলো। যদিও সময় বলে আমার কাছে কোনও টপিক নেই। বার্ট্রান্ড রাসেলই যথার্থ বলেছেন, "মানুষ ঈশ্বরকে তাদের নিজেদের আকৃতির মতো করে চিন্তা করে, আবার ঈশ্বরও হয়তো মানুষকে তাঁর নিজের আকৃতির মতন করে সৃষ্টি করেছেন।" এখানে দারুণ একটা মেসেজ আছে। আপনি যদি কোনও এনিমেটেড মুভি দ্যাখেন, সেখানে দ্যাখবেন, পরিচালক যত অদ্ভুত প্রাণীই বানাক না কেন, তাকে মানুষের মতো করে আকৃতি দেয়, অন্তত মাথাটা রাখে। এটা কেন করে? কারণ মানুষ চিন্তাশূন্য।  চিন্তাশূন্য মানুষ বলতে, চিন্তা করতে না পারা বা বুদ্ধিহীন মানুষ না। চিন্তাশূন্য মানুষ বলতে, একেবারে শূন্য চিন্তায় যাদের পুরানো অতীত ব্যতীত আর কিছুই নেই। মানুষকে ছোটবেলা থেকে ভুলভাবে বড় করা হয়েছে। একটা ছোট বাচ্চা মা-বাবাকে দ্যাখেই সব শেখে। সে যখন বড় হয় তখন তার তুলনার মধ্যেও মাপকাঠি থাকে তার বাবা-মা। যাদেরকে তার বাবা-মায়ের মতন মনে হয় না, তাদেরকে দ্যাখে সে হাসে, ব্যঙ্গ করে, ঘৃণা করে। মূলত মানুষের সমস্যার উৎপত্তি এখানেই।
জহির সাহেবের কিছুটা মেজাজ গরম হলো। একজন মানুষ হয়ে বোধহয় তিক্ত এসব সত্য বুলি তার সহ্য হচ্ছিল না। তিনি রাগে কিছুটা ফুঁসতে থাকলেন। তৃষাণা মানুষের ইমোশন বোঝে কিনা, তিনি তা জানেন না। এই মুহূর্তে তার শহীদুল ইসলামের সেই সর্তক বাণী বারবার কানে বাজছে। একটু অসাবধান হলেই মৃত্যু। মজিবকেও সাবধান করে দিয়েছেন তিনি। এই প্রথম মনে হচ্ছে, রোবট বাসায় এনে ভালোই বিপদে পড়েছেন তিনি।


# ৩য় পর্ব



জহির সাহেব মেয়েটার দিকে তাকালেন। মেয়েটা মানুষ না, রোবট। মানুষের সাথে মানুষিক, অমানুষিক আচরণ করা যায়; রোবটের সাথে তেমন কিছুই করা যাবে না। শহীদুল ইসলামের জোর নির্দেশ আছে, রোবটের সাথে কোনওরূপ খারাপ আচরণ বা আঘাত করা যাবে না। তাতে প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে। এজন্যই মজিবকে এব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। জহির সাহেব উঠে নিজের রুমে চলে এলেন। স্ত্রীর ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। একবার তিনি নরওয়ে ঘুরতে যাবেন -বলে মনস্থির করেছেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিবেন। ব্যাংকে তেমন টাকা নেই। টাকা জমাতে হবে। সাতটা মাটির ব্যাংক কিনে আনলেন। প্রতিদিন তিনি আর তার স্ত্রী কিছু-না-কিছু তাতে জমা রাখতেন। এভাবে করে পাঁচটা ব্যাংক পূর্ণ হলো। নরওয়ে যাওয়ার মতন হয়েছে কিনা, তা কে জানে! তবুও টাকা জমাতে থাকলেন। একদিন চোর তাদের নরওয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিলেন।
স্ত্রীকে তিনি ভীষণ ভালবাসতেন। তার প্রমাণ পেয়েছেন যখন স্ত্রীর বাচ্চা হচ্ছিল না, তখন। সেই অসময়ে তিনি চাইলেই আরেকটা বিয়ে করতে পারতেন। স্ত্রীও তাকে এব্যাপারে জোরাজুরি করেছিল। তিনি করেন নি, এনিয়ে তার কোনও আফসোসও নেই। তবে তার অবচেতন মন এবিষয়ে বোধহয় আফসোস করত। মাঝেমাঝেই ভুলবশত তিনি ছোটমেয়ের ড্রেস কিনে বাসায় ফিরতেন। তার স্ত্রী সেগুলো ফেলে দিত। তিনি রাগ করতেন না। এই অনিবার্য রাগে নিরব হাসি ঠোঁটে নিয়ে থাকার নামই বোধহয় 'পবিত্র প্রেম'।
জহির সাহেবের ভালো লাগছে না। স্ত্রীর কথা মনে পড়লে তিনি মাঝেমাঝেই বিষণ্ণ হয়ে যান। তার স্ত্রী গত হওয়ার পর সবাই তাকে সংসার করতে বললেও তিনি তাতে রাজি হন নি। তারমতে, একজন ব্যক্তি নিয়েও সংসার হয়, করা যায়। তাকে অনেকে পাগল বলে সরে এসেছে। তিনি সরে যান নি; নিজের থেকে। জহির সাহেব উঠতে যাবেন এমন সময় তৃষাণা এসে বলল, আপনার পুরানো বাক্সে একটা খাম খুঁজে পেয়েছি। অর্থহীন খাম। দ্যাখুন!
জহির সাহেব কিছুটা অবাক চোখে হলুদ খামটা নিলেন। খামের ভেতরে বহু বছর আগের পুরানো হাসিটা হঠাৎই কান্নার কারণ হতে পারতো, কিন্তু জহির সাহেব নির্লিপ্ত চোখে সেদিকে তাকালেন। তখন তিনি ক্লাস ফাইভে পড়েন। তাদেরই ক্লাসের একটা মেয়েকে একটা প্রেমপত্র দিয়েছিলেন। মেয়েটা প্রেমপত্র ফিরিয়ে না দিয়ে পেনসিল দিয়ে একটা বিয়েবাড়ির ছবি এঁকেছিলো। সেখানে জামাইয়ের সাজে জহির সাহেব আর বৌয়ের সাজে তিন্নি নামের মেয়েটা। ক্লাস সেভেনে পর্যন্ত তাদের ভালোই চলছিল সব। ক্লাসের সবাই ব্যাপারটাকে বাঁকা চোখে দ্যাখলেও তারা প্রেমকে নতুনত্বের আবিষ্কার হিশেবে দ্যাখতো। তিন্নি একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুই সত্যিই আমাকে বিয়ে করবি তো?
করব তিনু।
আর কোনও মেয়েকে কখনও চিরকুট দিবি?
জীবনেও না।
তিন সত্যি বল।
তিন সত্যি।
তিন্নি রাগ করে বলল, উঁহু! তিন সত্যি কিভাবে বলতে হয়, তোকে শিখিয়েছিলাম না?
হুম।
ভুলে গেছিস?
না।
তাহলে বল তো!
জহির সাহেব বিরক্তমুখে বলতেন, সত্যি সত্যি সত্যি!
তিন্নি সেইবার প্রথমবারের মতো জহির সাহেবকে জড়িয়ে ধরেছিল। জহির সাহেব তখন যৌনতার ব্যাপারে ভীষণ কাঁচা ছিলেন। তবুও তার মনে হলো, শরীরের কোথায় যেন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি নিষিদ্ধ অথচ পবিত্র টান রয়েছে। মানুষ নোংরামির মধ্যে যৌনতা খুঁজে পায়, কিন্তু যৌনতার মধ্যে হিংস্রতার নোংরামি খুঁজে পায় না।
জহির সাহেব একদৃষ্টে বিয়েবাড়ির ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তৃষাণা বিরক্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে বলল, মানুষ অর্থহীন কাজে সময় অপচয় করে। এই আমাকে দ্যাখুন, আমরা অমর। তাই সময়ের গুরুত্ব আমাদের কাছে নেই, তবুও আমরা সময় অপচয় করতে রাজি নই।
জহির সাহেব টেনে টেনে বললেন, তৃষাণা, তুমি এসব ছোটখাটো ব্যাপারে বড়সড় কষ্ট কখনও বুঝবে না।
বুঝতে চাইও না।
জহির সাহেব চুপ করে মেয়েটির দিকে তাকালেন। তৃষাণা আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে। নারীর সহজাত প্রবৃত্তির একটা অংশ হলো সেজেগুজে পুরুষের সামনে আসা। তৃষাণা বোধহয় নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করেছে। সে জহির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, জহির!
জহির সাহেব আঁতকে উঠলেন। তার বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল, এজন্য না যে, তৃষাণা তার নাম ধরে ডেকেছে; বরং এজন্যই যে, তার গলার স্বরটা অবিকল তার স্ত্রীর মতন। তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, তৃষাণা...
হ্যাঁ জহির, আমি এখন আপনার স্ত্রীর মতন গলা করে ফেলেছি। আপনি চাইলে তিন্নির মতন গলাও আমি করতে পারি। করব?
না!
সেটাই বরং ভালো হয়।
জহির সাহেব কিছুটা রেগে বললেন, তুমি আমার স্ত্রীর গলার স্বর নকল করবে না।
আপনি শান্ত হোন। আমি জানি, আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। গতরাতে আমার কথা ভেবে ভেবে চোখ লাল করেছেন। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান?
জহির সাহেবের মনে হলো, তার জ্বর চলে আসছে। তার কাছে সকল জিনিশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তার মাথা বিভ্রান্ত হচ্ছে, ঘুরাচ্ছে। এতটা অপমানিত তিনি কখনওই হোন নি। তিনি ভূত দ্যাখার মতন চমকে উঠার ভান করে বললেন, তুমি কিভাবে জানো?
আমার হলোগ্রাফিক মনিটরের সাথে আপনার মস্তিষ্কের কানেকশন আছে। আপনি যা চিন্তা করবেন, আমি তা দ্যাখতে পাবো।
জহির সাহেব এই ঠাণ্ডায়ও ঘামছেন। পাশে গামছা পড়ে আছে, তিনি ঘাম মোছার প্রয়োজন মনে করলেন না। তৃষাণা বলল, আপনি এই মুহূর্তে আমাকে মেরে ফেলার কথা ভাবছেন। কিন্তু তা আপনি করতে পারবেন না দুটা কারণে। ১. আপনি নরম হৃৎপিন্ডের ভালো মানুষ। ২. আপনি আমাকে আঘাত করার আগেই আমার শরীর থেকে বের হওয়া কারেন্টের ওভার ভোল্টেজে মারা যাবেন।
জহির সাহেব ভাবছেন, না, এই মেয়েটাকে আর বাসায় রাখা যায় না। চিন্তাজগত মানুষের পার্সোনাল বেডরুম। এখানে যখন-তখন কেও ঢুকে পড়াটা সমীচীন নয়। তৃষাণা মৃদু হেসে বলল, আপনি চাইলেই আমাকে বিদায় করতে পারবেন না। কারণ আমাকে কে বানিয়েছেন জানেন?
'না।' জহির সাহেব আর অবাক হলেন না। বোধহয় মানুষ সর্বোচ্চ অবাক হওয়ার সীমা পেরিয়ে গেলে আর অবাক হতে পারে না। তখন আস্তে অবাক হওয়াটা কমে আসে। যেমন মানুষ বৃদ্ধ হতে হতে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেলে আর বড় হয় না, আস্তে আস্তে ছোট হয়। সেজন্যই বৃদ্ধদের শিশুদের সাথে তুলনা দেয়া হয়।

তৃষাণা বলল, আপনি হয়তো ভাবছেন, আমাকে শহীদুল ইসলাম বানিয়েছেন। না, এই তথ্য ভুল। আমার নির্মাতা হারুজি বানিয়েতা। তিনি জাপানিজ। তাঁর বানানো এই আমি জাপানে পুরষ্কার পেয়েছিলাম একটা প্রদর্শনীতে। কিন্তু তার পরপরই শহীদুল ইসলাম আমাকে চুরি করেন। তিনি মানুষটা অমানুষ। তার একটা লক্ষ্য ছিল, আপনাকে খুন করা। তাই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আমার মনিটরে একটা বিস্ফোরণ হবে। সেই নির্দিষ্ট সময়টা আমি জানি না। তখনই আপনি আমি দুজনেই ধ্বংস হয়ে যাব। অবাক হচ্ছেন তো? কেন আপনাকে শহীদুল ইসলাম মারবেন, বলুন তো?
জানি না।
জানিয়ে দিই?
লাগবে না।
আচ্ছা। তবে আমার একটা শেষ ইচ্ছা আছে স্যার।
জহির সাহেব হতাশ চোখে তাকিয়ে বললেন, প্লিজ তৃষাণা, তুমি আমার স্ত্রীর মতো আমাকে 'স্যার' বলবে না।
আচ্ছা বলব না। আপনি আপনার স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসতেন। তার প্রমাণ অনেক। এর মধ্যে একটা হলো, আপনার বেডরুমে আপনার বিছানার পাশে রঙ করা উঁচু জিনিশটা কি -তা আমি জানি। অইটা আপনার স্ত্রীর কবর। আপনি মধ্যরাতে স্ত্রীর কবর জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। আমি এই আবেগগুলো সামান্য পরিমাণে অনুভব করি। কারণ, আমার ডিভাইস তৈরী করার সময় হারুজি সাহেব তার স্ত্রী এবং তিন কন্যাকে হারিয়েছিলেন একটা বাস দুর্ঘটনায়। সেই ঘটনায় মর্মাহত হয়েই বোধহয় তার আমার মতন একটা রোবটকে মানবিক করার একটা প্রয়াস ছিল...
তোমার বোধহয় একটা শেষ ইচ্ছা ছিল।
জি।
বলে ফেল।
তৃষাণা কিছুটা মানবিক আবেগে দরাজ গলায় বলল, আমি আপনাকে একবার ছুঁতে চাই স্যার।
জহির সাহেব মেয়েটার দিকে তাকালেন। তার কপালে কালো টিপ, এই রোবট-টাকে এত বেশী মানুষের মতো লাগছে যে, অমানুষকেও বোধহয় এত বেশী মানুষিক লাগে না কখনও। তিনি ঠোঁটে কিছুটা হাসি এনে বললেন, প্রায়শই তো আমার হাতের সাথে তোমার হাত লেগে যায়।
তৃষাণা কিছুটা বিষণ্ণ গলায় বলল, স্যার, অইটা ধরা, ছোঁয়া না।
জহির সাহেব মাথানিচু করে বললেন, তৃষাণা, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও।
জানি স্যার, আপনি এখন কাঁদবেন। আমি কি আপনার পাশে বসে আপনার চোখের পানি একবার দ্যাখতে পারি?
না।
প্লিজ স্যার।
আমাকে স্যার বলবে না।
তৃষাণা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। এই মেয়েটাকে দূর করতেই হবে। কালকেই মজিবকে খবর দেয়া হবে। যেকোনো উপায়েই হোক একে তাড়াতে হবে।
স্যার।
বলো।
আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না প্লিজ।
তোমার কোনও আবেগ নেই। তুমি যার-তার কাছেই যেতে পারো।
একটা বেশ্যাও যার-তার কাছে যায়। কিন্তু তারও একটা আবেগ থাকে, চাহিদা আছে, ইচ্ছার বিলাস আছে। কেও বেশ্যার ঠোঁটের দিকে তাকায় না, কারণ বেশ্যাকে কেও ভালোবাসে না।
তোমার কথা লজিক্যাল। কিন্তু ও মানুষ।
স্যার আমি সারাজীবন আপনার সেবা করব। তবুও আমাকে তাড়াবেন না প্লিজ।
তুমি কিন্তু একটু আগে বলেছিলে, তোমাকে চাইলেও আমি তাড়াতে পারব না।
তৃষাণা মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কি বলো নি?
জি। কিন্তু দিনে-দিনে আমার এনার্জি লস হচ্ছে। একটা সময় আমি মানুষের হাতের পুতুল হয়ে যাব, অথবা ধ্বংস হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাব; বোধহয় দ্বিতীয়-টাই সত্য।
তৃষাণা।
জি।
তুমি এখন যাও।
স্যার, আমি কি আপনাকে একবার ছুঁতে পারি?
চাইলে পারো। কখন ছুঁবে?
তৃষাণা নিশ্চুপ।
কি হলো, বলো?
স্যার, আমার এনার্জি প্রায়ই শেষের পথে। বিস্ফোরণের সময় বোধহয় ঘনিয়ে এসেছে। আপনাকে ছুঁতে হলে আমার সোর্সের মধ্যে অনেক এনার্জির সঞ্চার করতে হবে। তার জন্য সময় লাগবে। আমার এই এনার্জির সঞ্চারের জন্য আপনার কাজ করার সময় কম পাবো।
পেলে পাবে, আমি হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসব। কতক্ষণ ছুঁবে তুমি?
সর্বোচ্চ ১৩ ন্যানো সেকেন্ড।
আচ্ছা।
তৃষাণা বিষাদ মাখা গলায় বলল, স্যার।
জহির সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, এই শেষবার! আর কখনওই স্যার বলবে না।
আচ্ছা বলব না।
কি বলতে চাইছিলে, বলে চলে যাও।
তৃষাণার চোখে বোধহয় কিছু একটা হচ্ছে। কান্না কিনা, তা জহির সাহেব বুঝতে পারছেন না। পৃথিবীর সকল প্রাণীই চোখ ভিজিয়ে কাঁদে। রোবটের কান্না কেমন, তা নিয়ে তার স্টাডি নেই। তবে তার মনে হচ্ছে, তৃষাণার মন ভালো নেই। হয়তো অনর্থক চিন্তা। তৃষাণার তো মনই নেই!
তৃষাণা এলকোহলিক কান্না এনে এই প্রথম কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমাকে কেমন লাগছে...?


# শেষ পর্ব


জহির সাহেব রোবট মেয়েটার দিকে তাকালেন। তাকে কেমন লাগছে, সেটা সে না জেনে যাবেই না। তাকে দ্যাখতে অসহ্য সুন্দরীর মত হলেও তাকে কেও বিয়ে করতে পারবে না। মানুষের মন আছে, রোবটের তা নেই, রোবটের মধ্যে সামান্য মায়া সেট করা গেলেও তা প্রযুক্তিগত, প্রকৃতি প্রদত্ত নয়। জহির সাহেব মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে তিনুর মতো লাগছে।
মেয়েটা বোধহয় কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর মুখ লুকিয়ে চলে।
বেশ কিছুদিন ধরে তৃষাণা এনার্জি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে। কিছুটা এনার্জি হয়েছেও। তবে এত কম এনার্জি দিয়ে জহির সাহেবকে ছোঁয়া যাবে না। আবার বিস্ফোরণের সময়ও বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। ঠিক কোন ব্যাপারটা আগে ঘটবে, সে ব্যাপার নিয়ে সে ভীষণ সন্দিহান।

জহির সাহেব একটু আগে মজিবের বাসা থেকে বের হয়েছেন। মজিব তাকে দ্যাখে ভীষণ খুশি হয়েছে। সে আগেই বিপদের আশংকা প্রকাশ করেছিল, তা সত্যি হওয়াতে তার মধ্যে কেমন যেন একটা বীরত্বের ভাব ফুটে উঠেছে। মানুষ যদি বলে, দ্যাখে নিও গাড়িটা এত দ্রুত চলছে, এক্সিডেন্ট করবেই। তখন এক্সিডেন্ট করলে সে হো হো করে হেসে বলে, দ্যাখেছো...? কিন্তু সেও যে একই গাড়ির সদস্য, এবং তাকেও যে হাসপাতালে যেতে হবে, এবিষয়টা তখন তার মাথায় থাকে না। মজিব তৃষাণাকে তাড়াবে না। সে নাকি কোন লোককে আনবে, সেইই তৃষাণার সকল ডিভাইস নষ্ট করে দিবে, তৃষাণা আঘাত করার আগেই হলোগ্রাফিক পর্দায় তার সমস্ত এনার্জি অন্য ডিভাইসে কনভার্ট করা হবে। সমস্ত এনার্জি কনভার্ট করার একটু আগে অর্থাৎ বিস্ফোরণের একটু আগে তার মাথার খুলি খুলে রাখা হবে। আপদ দূর না করলে জহির সাহেবের মতন সাধারণ মানুষটা মারা যাবেন। জহির সাহেব ভীষণ উপকৃত হয়ে মজিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার বাসা ছেড়েছেন। কিন্তু কিছুটা হাঁটার পর তার মনে হলো, না, তৃষাণাকে এভাবে ধ্বংস করা ঠিক হবে না, তার ভীষণ কষ্ট হবে। আবার জহির সাহেব নিজেকে বোঝাচ্ছেন, না, তৃষাণা একটা রোবট। ওর মধ্যে কোনও আবেগ, ভালবাসা নেই। তার জন্য যদি নিজেকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়, তবে ওকে নিঃশেষ করাই ভালো। তার উপর তার স্ত্রীর কবরটাও হয়তো বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা তিনি কখনওই মানতে পারবেন না। আবার জহির সাহেব ভাবছেন, তার স্ত্রী তৃষাণার মাঝে ফিরে এসেছে। তৃষাণা অবিকল শুধু তার স্ত্রী কেন, তিন্নিকেও নকল করে করতে পারে। অবসর সময়ে মেয়েটার সাথে কথা বলে সময় কাটানো যাবে। আবার তার মস্তিষ্ক ভাবছে, না! কিছুদিন পরে বিস্ফোরণেই তো সব শেষ। জহির সাহেব এখন কনশাস আর সাব-কনশাস মাইন্ড নিয়ে বিপদে আছেন, তার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, তৃষাণার মতন রোবট হলেই বোধহয় ভালো ছিল!
জহির সাহেব কি ভেবে দুটা শাদা গোলাপ কিনলেন। মাঝেমাঝেই তার স্ত্রীকে দিতেন, আজ দিবেন তৃষাণাকে। মেয়েটা কি উপহার পেলে খুশি হবে? তাকে মেরে ফেলার আগে তাকে খুশি রাখা উচিত। সে খাদ্য গ্রহণ করে না, তা না হলে তিনি নিজেই তৃষাণার জন্য রাঁধতেন। জহির সাহেব ধীর পায়ে বাসায় পৌঁছলেন। পকেটে এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে খুব শান্তভাবে ডাকলেন, তৃষাণা।
কোনও জবাব নেই।
আবার ডাকলেন, তৃষাণা, একটু এদিকে আসো।
পুরো ঘর নিশ্চুপ। তিনি হতভম্ব হয়ে পুরো ঘর তল্লাশি করলেন, তৃষাণার কোনও চিহ্নও নেই, কোনও চিরকুট নেই, নেই কোনও চিঠিও। জহির সাহেব বিছানায় বসে পড়লেন। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। খুব সম্ভব, এই শহরে তুফান হবে আজ। তার মনে হচ্ছে, তার শরীরের পারদেরও আজ তুফান হবে।

বেশ অনেক বছর পরের কথা...
কয়েকজন বনভোজন করতে এসেছে। পাশেই জহির সাহেবের বাড়ি। বাড়ির ভেতর দুটা কবর, একটা তার, বাকিটা তার স্ত্রীর। অনেকের কাছেই এটা ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বামী তার মৃতা স্ত্রীর কবরের সাথে দীর্ঘদিন বাস করেছেন। আজ মৃত্যুর পরও তারা পাশাপাশি, কাছাকাছি। বাড়িটার সবকিছুই ঠিক আছে, তবে মাঝেমাঝেই সেখানে বেশ কয়েকজন মানুষ হার্ট-এটাক করে মারা যান। সাহসীরা এখানে রাত কাটাবার কথা ভাবে। আজও হয়তো ছেলে-মেয়েগুলো এখানে রাত্রি যাপন করবে। হয়তো কাওকে শত্রু মনে(!) হলে সে হার্ট-এটাকে মারা যাবে। ফিরোজা নামের মেয়েটা সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, আসলে ঘটনা অন্য। বেশ অনেক বছর আগে নাকি একটা রোবট সুইসাইড করেছে। শুনতে হাস্যকর মনে হলেও নাকি ঘটনাটা সত্যি। খুব সম্ভব সে কিছু পেতে চেয়েছিল, কিন্তু পায় নি।
গিফরী হাসতে হাসতে বলল, প্রাণীজগতে সাপ, বানর এমনকি হরিণকেও সুইসাইড করতে শুনেছি; কিন্তু রোবটের কথা এই প্রথম। হা হা হা!
ফিরোজা বিরক্তমুখে বলল, আজব! লোকমুখে কথিত। আমি কি সিউর জানি নাকি...? রাত হলে নাকি সে রোবট-টা কবর দুটা পাহারা দেয়। জানি না সঠিকটা। অনেকটা প্রভুভক্ত কুকুরের মতন।
রাত আরও বাড়ছে। বনভোজন টিম বসে আছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়বে মাটির উপর। মাটির নিচেই তো দুজন শুয়ে আছে, তাই তারা মৃত, আর আমরা মাটির উপর শুই বলে আমরা জীবিত। উপরের তলার মানুষগুলো সবসময়ই ভালো অবস্থানে থাকে, এটা কি ঠিক...?

রাত বাড়ছে, দিন এগিয়ে আসছে। ভোরের অপেক্ষায় শত শত রাত্রি বসে আছে। ভোর দিনের শুরু, রাতের শেষ। না দিন, না রাত্রি। আলো আঁধারির খেলা। ঠিক এই সময়েই জহির সাহেবকে প্রথম জড়িয়ে ধরেছিল তার স্ত্রী, এমন 'না দিন না রাত্রি'র নাম দিয়েছিল "রৌদ্রজ্জ্বল রাত্রি"...


                           
                                  সমাপ্ত

     * কমেন্ট বক্সে অবশ্যই কমেন্ট করে
    জানাবেন গল্পটি কেমন লাগব.....ধন্যবাদ *

ভালোবাসা বিষয়ক টিপস -১০

love-tips ♥ তুমি পাশে নেই তবুও তোমায় অনুভব করি। তুমি আমার হবে না জানি তবুও তোমার পথ চেয়ে আছি। সপ্ন সত্যি হবে না জানি তবু তোমায় নি...