গল্প : লেখকের প্রেম # লেখক- ইমরান
* ১ম পর্ব
গতকাল প্রেমিকার মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছি। ঝগড়ার কারণটা খুব তুচ্ছ। কিন্তু মহিলার কাছে এটাই আকাশ-পাতাল কারণ। আমার মতো ছেলের সাথে রাতদুপুরে কথা বলার অপরাধে তিনি তার মেয়ের ফোন কেড়ে নিয়েছেন। দুদিন পর সাবিলা তার এক বান্ধবীর ফোন থেকে আমাকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে কথাটা জানাল। তার শেষ কথা ছিল, আমাকে প্লিজ তুলে নিয়ে যাও...! আমি তাকে তুলে না আনলেও তার ঠিকানায় জমানো টাকা থেকে একটা নূতন ফোন পাঠিয়ে দিয়েছি। আন্টি নাকি এই ফোনটাও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাবিলা চোখে-তে রক্ত এনে দাঁত-মুখ কুঁচকে বলেছিল, খবরদার! ফোনটা টাচও করবে না। এটা তুমি কিনে দাও নি। আমার জামাই কিনে দিয়েছে।
আন্টি ঠিক সেদিনই রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমাকে ফোন দিলেন। রাগ ধরে রাখতে না পেরে কিছুক্ষণ চিল্লাচিল্লি করে বললেন, তুমিই তাহলে ফোনটা কিনে দিয়েছো। রাইট?
আমি ফ্যালফ্যাল করে হেসে বললাম, জি আন্টি। আপনাকে আসসালামু আলাইকুম।
আগেও একবার সালাম দিয়েছিলে। প্রতিটা কথায় সালাম দাও নাকি?
জি আন্টি, অভ্যাস। আসসালামু আলাইকুম।
শাট আপ! এতবার সালাম দেয়া লাগবে না।
জি আচ্ছা, শোকরিয়া।
আন্টি কিছুটা রাগ কমিয়ে এনে বললেন, সাবিলা তোমাকে 'জামাই' বলে সম্বোধন করেছে। এটা কেন? তুমি কি ওকে বিয়ে করেছো?
আমি হাসিমুখে বললাম, জি না। তবে করব সামনে ইনশাল্লাহ। দোয়া রাখবেন।
দোয়া রাখব, নাকি পুলিশ রাখব -তা তো সময়েই বলে দিবে।
আন্টির চোখেমুখে বিজয়ের হাসি। আমাকে ভাল করে একটা ভয় দ্যাখানো গেছে। এই ভয়ে আমি কাবু হয়ে আর উঠতে পারব না বলে তিনি ভাবছেন। কিন্তু এই জগতে অনেক কিছুই উল্টো পথে হাঁটে। তার সমগ্র বিজয়কে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে আমি ফ্যালফ্যাল করে হেসে বললাম, জি আচ্ছা। পুলিশও রাখতে পারেন। আমার দুলাভাই একজন পুলিশ অফিসার। উনিও বিয়েতে থাকবেন। আর আমার এক ভাই আর্মি। তাকেও দাওয়াত করা হবে। আপনি চাইলে আরও কয়েকজন পুলিশকে দাওয়াত দিতে পারেন। আমি আরও ভাবছিলাম, ঢাকা শহরের সব ট্র্যাফিক পুলিশকে দাওয়াত দিব। তাঁরা এত কষ্ট করেন সারাটাদিন, অথচ ড্রাইভার আর পাবলিকের গালি ছাড়া কিছুই পান না। তারা এবার একটা বিয়া খাক। আইডিয়া-টা কেমন হলো?
আন্টি ফোন ধরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার সামনে না থেকে বেঁচে গেছি -বলে হয়তো আমার ভাগ্যকে স্যালুট জানাচ্ছেন। তার গলা প্রায় ভারী হয়ে আসছে। গলা ভারী হয় দুটা কারণে, ১. কান্না পেলে। ২. রাগের চূড়ান্ত মুহূর্তে। তিনি রাগের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে বললেন, তুমি কিভাবে বিয়ে করবে, তা আমি দ্যাখব। আর কাকেই-বা করবে, তাও দ্যাখব। সাবিলাকে বিয়ে করবে? যোগ্যতা কি? কি করো তুমি?
আমি কিছুটা গৌরবের সাথে বললাম, আমি শব্দ শ্রমিক।
কি কি? কি তুমি? শ্রমিক?
জি, শব্দ শ্রমিক।
মানে কারখানায় কাজ করো?
জি না। লেখালেখি করি। শব্দের সাথে শ্রম মিশাই।
আন্টি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কথাটা তার কান থেকে মাথায় পৌঁছুতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। তারপর হো হো করে ব্যঙ্গার্থ হেসে বললেন, তুমি লেখক?
জি।
তুমি লেখক হয়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছো?
জি। লেখক হয়ে আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি। বিয়ে করতে এসে লেখক হয়ে যাই নি।
স্টপ নাউ! লেখকদের ইনকাম আমার জানা আছে। চুল দাড়ি বড়, গাঁয়ের তামাকের গন্ধে কেও পাশেও যেতে পারে না। লেখকদের আশেপাশে তো কাউয়ারাও ভীড় করে না। তুমি মেয়ে পাবে, ভাবলে কিভাবে? অবশ্য এম্বিশন থাকা ভাল।
আপনার মেয়ের এব্যাপারে কোনও অভিযোগ নেই। ও লেখক বিয়ে করতে রাজি আছে।
আমি রাজি নই।
দুঃখিত, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করব, আপনাকে নয়।
মহিলা হতভম্ব হয়ে গেলেন। খুব সম্ভব তার মুখের উপর এতবড় কথা কেও কখনও বলে নি। আমার মতো ছোঁকড়াদের এত বেশী সাহস হয় কি করে! 'দ্যাখো, আমি তোমাকে শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, আর কখনওই আমার মেয়েকে ফোন দিবে না। তাকে যে ফোনটা কিনে দিয়েছো, তাও নিয়ে যাবে। তা না হলে হাজতে বসে লেখালেখি করবে। যত্তসব ফাযিল কোথাকার!'
জি শোকরিয়া! আপনার মেয়েকে আর ফোন দিব না। আমি তো ফাযিল, তাহলে আপনার স্বামী কি? সে খেয়াল আছে? সাবিলার বান্ধবীদের সাথে সারাটাদিন কি করে বেড়ায়, সেগুলো আগে দ্যাখুন। নিজের স্বামীকে ঠিক করুন, তারপর অন্যের স্বামী নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবেন। যত্তসব!
মহিলা হকচকিয়ে গেলেন। তার স্বামীর সাথে বেশ কিছুদিন ধরে তার মৌন ঝগড়া চলছে। এই ধরনের ঝগড়ার মাঝখান দিয়ে এসে কেও তুচ্ছ কিছু বলে ফেললেও সিরিয়াসলি নিতে ভাল লাগে। মহিলারও তেমনি হয়েছে। তিনি হঠাৎই গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার স্বামী কি করেছে?
কি করেন নি, তাই বলুন। সাবিলা তার বান্ধবীদের নিয়ে বাসায় যায়, আর বুড়াটা মা মা বলে কাছে টানে। আদরের নাম করে এখানে-ওখানে হাত দেয়। চুল, দাড়ি সব পেকে শনপাপড়ি, কিন্তু মনটা এখনও তরুণ। আর বেশী কিছু বলতে পারব না। এখনকার জন্য বিদায়। আসসালামু আলাইকুম।
মহিলা 'এই শোনো শোনো' বলে কিছুক্ষণ চেঁচালেন। কিন্তু কোনও লাভ হলো না, আমি ফোন রেখে দিলাম।
মহিলা রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে গেছেন। তার মনে হল, তিনি এতদিন ধরে যা ভেবে এসেছিলেন, তা সত্যই হলো তাহলে...! রাগে কাঁঁপতে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে সংযত করে তার স্বামীর রুমে এলেন। তার স্বামী মহিন আকবর সাহেব সাবিলার বান্ধবীদের সাথে কথা বলছিলেন। আমার কথা এভাবে সত্য হয়ে যাবে, তা ভদ্রমহিলা ভাবতেই পারেন নি। মহিন আকবর সাবিলার বান্ধবী তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল, মা, আমি বললামই তো আমি তোমার জন্য সবসময় দোয়া করি।
তিতির ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি না। যদি দোয়া করতেনই তাহলে আমি পরীক্ষায় ফেল করলাম কেন? আমার মাথা ছুঁয়ে বলেন, দোয়া করি মা তোমার জন্য।
তিতিরের একটা বদভ্যাস হলো, সে কাওকে ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মাথায় কেও হাত রেখে শপথ করছে। মহিন সাহেব উপায়ান্তর না দ্যাখে হাসিমুখে তিতিরের মাথায় হাত রেখে শপথ করলেন। সাথে সাথে কোথা থেকে উড়ে চলে এলেন তার স্ত্রী। মহিন সাহেবের হাত তখনও তিতিরের মাথায়। ভদ্রমহিলা দাঁত-মুখ কুঁচকে ফেলার সাথে তিনি হাত সরিয়ে নিলেন। সাবিলা পরিস্থিতি উল্টোদিকে যাচ্ছে দ্যাখে তিতিরকে নিয়ে রুমে নিয়ে গেল। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে মহিলার চোখে জল চলে আসছে। তিনি ভারী গলায় সারা শহরের কাক ডাকা রাগ এনে বললেন, ও আচ্ছা, এখন তাহলে কচি মেয়েগুলার মাথায় হাত রাখা হচ্ছে, তাই না? আমার মাথায় হাত রাখার সময় কি বল তুমি, বল, আমার মাথায় তেল। তেলা মাথায় হাত দিলে তোমার হাত ধুতে হয়। আর কচি মেয়েদের মাথা খুব শুকনা, তাই না? আমি চললাম।
ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। মহিন সাহেব হতভম্ব মুখে সোফার সাথে সেঁটে রইলেন। পরিস্থিতি এত খারাপ হবে, তিনি কল্পনাই করতে পারেন নি। তিতির নিশ্চয়ই কথা গুলো অন্যরুম থেকে শুনেছে। মহিলারা রাগের সময় কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না, এটাই বড় সমস্যা। মহিলা চলে গেলেন কিন্তু মহিন সাহেবকে এবার আরও অবাক করে দিয়ে তিতির আর সাবিলার বান্ধবী সবগুলোকে এনে বললেন, তোমরা বস। তিতির, তুমি চুপ করে বস। বেশ কিছুদিন ধরে তুমি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বাসায় আসছো, আজ এটার সুরাহা হবে। এভাবে আর কতদিন চলবে...? আমি এক্ষুণি কাজী ডেকে এনে সাবিলার বাবার সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দিব। শালা বুইড়া!
*২য় পর্ব
ভূতেরা কি প্রেম করে...? তারা কি বিয়ে করে? বাচ্চা নেয়? তাদেরও কি মানুষের মতন যৌনাঙ্গ আছে?
সবগুলো চোখ বক্তার দিকে ঘুরে গেল। এখন সিরিয়াস সময় যাচ্ছে। মেয়ের বান্ধবীর সাথে বাবার বিয়ে, ঠিক এই মুহূর্তে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা সাজে না। কিন্তু লিজা প্রায়শই কিসের ভেতর কি -আনবেই। ভদ্রমহিলা চোখমুখ দিয়ে আগুন ছেড়ে বললেন, এই যে খুকি শোনো, পরিস্থিতি অন্যদিকে নেবার চেষ্টা করবে না। বেয়াদব মেয়ে একটা! বাসায় এসে সাবিলার রুমে চলে যাবে, ওর বাবার সাথে তোমাদের এত কি! সেদিন তুমি কি বলেছো আমি শুনেছি। বলেছিলে না, বত্রিশটা দাঁত বের করে, আল্লা আংকেল, আপনি এখনও কি হ্যান্ডসাম। যেকোনও মেয়েই পাগল হয়ে যাবে। বাবার সমতুল্য একজন মানুষের সাথে কেও এভাবে কথা বলে...? ফাযিল একেকটা! বাসায় আসো কি বুড়াটাকে দ্যাখতে...? কি আছে ওর মধ্যে? মাঝেমধ্যে বুড়াটাও হাসি হাসি তোমাদের সালামি দেয়, এটা নিতেই কি সবগুলা দাঁত বের করে প্রশংসা করতে হবে...? যত্তসব!
তিতিরের কান্না পাচ্ছে। সে ভাবতেও পারে নি, এত বুড়ো কারও সাথে তার বিয়ে হতে পারে? আন্টি কি মজা করছেন নাকি সিরিয়াস? তিতির চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। বান্ধবীর মা হতে পারার মধ্যে গৌরবের কিছু নেই। ধিক্কারের অনেককিছু আছে। সাবিলা লজ্জায় প্রায় মরে যাবে -টাইপ অবস্থা। বান্ধবীদের সামনেই তার বাবা-মা ঝগড়া বাঁধান। এমনিতেই মান-ইজ্জত সব অনেক আগেই চলে গিয়েছিল, এখন অবশিষ্টাংশও যাচ্ছে।
২.
বেশ কিছুদিন ধরে একটা ঝামেলায় আছি। আমাদের বাথরুমটা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। যেই যাচ্ছে, আছাড় খাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকবার তা অনেকভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু সবই অরণ্যে রোদন। আমি নিজেও তিন তিনবার আছাড় খেয়ে করুণ দশা। আজ তারচে'ও আরও খারাপ একটা ঘটনা ঘটে গেল। কে যেন কাপড় ধোয়ার জন্য বালতি-তে কাপড় ভিজিয়েছে, পাশে রেখেছে 'নীল', নীল রেখেছে ভাল কথা, কিন্তু খারাপ কথা হল, নীলটা রেখেছে উন্মুক্ত অবস্থায়। আমি নিয়মমতো উপুড় হয়ে আছাড় খেয়ে সারা শরীরে নীল মেখে নিলাম। নিজের অবস্থা এরচে' করুণ হয় নি কখনওই। আমার সব কাপড় একটু আগে ধুতে দেয়া হয়েছে। এখন যেটা পরণে আছে, তা পরেই আবার টিউশনিতে যেতে হবে। একটা ছেলের জীবনে বোধহয় অনেকগুলো কষ্টের মধ্যে এটাও অন্যতম। আমি নীলে মাখামাখি হয়ে টিউশনিতে গেলাম। একটা ক্লাস টুয়ের মেয়ে পড়াতে হয়। তার বাবা-মায়ের অনুরোধেই পড়াতে হচ্ছে। এর আগে তাদের পাশের বাসায় একটা মেয়েকে পড়াতাম। মেয়েটা তুচ্ছ অভিমানে আত্মহত্যা করেছিল। বর্তমানে যাকে পড়াই, তার জন্য প্রায় দশ হাজার টাকার খাটুনি খাটতে হয়। পড়া কখনওই তৈরি করে রাখবে না, ক্লাসে কি পড়িয়েছে তাও বেমালুম ভুলে যাবে, সবসময় গল্প করতে চাইবে, তার কোন বান্ধবী কেমন, বড়দের মতো- আমার প্রেমিকা কেমন আছে -এসব ছাইপাঁশ আলাপ-সালাপ করতে করতেই আমার জীবন শেষ।
মেয়েটার নাম ইমা। মাথার দুপাশে ঝুঁটি করে, তাকে গোলাপি-রঙা ড্রেসে মানায় দ্যাখে সবসময় গোলাপি ড্রেসই পরে। আজ প্রথম দশমিনিট আমার নীলের এই বেহাল অবস্থা দ্যাখে ঠোঁটের সামনে দু'হাত চেপে হাসতে হাসতে একবার চেয়ার থেকে পড়ে বিছানায় গিয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আম্মু আম্মু, একটু এদিকে আসো না প্লিজ! দ্যাখো ভাইয়ার কি অবস্থা! হা হা হা!
আমি বোকার মত ড্যাবড্যাব করে সেদিকে তাকিয়ে আছি অসহায় চোখে। মানুষের কষ্টে আমরা নির্মল আনন্দ পাই। কারণ মানবিক আর পাশবিক দুটাই আমরা আমাদের ভেতরে লালন করি। শিশুদের বেলায়েও কি তা সত্য...? আন্টি অন্যরুম থেকে দৌঁড়ে এলেন। আমার শার্ট নীলে ভিজে চটাচটি হয়ে গেছে দ্যাখে তিনিও পেট ধরে হো হো করে হেসে উঠলেন। এই ভদ্রমহিলার বেশী হাসি পেলে তিনি পেট ধরে হাসেন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, এবার আন্টিও কি বাসার অন্যান্যদের এই দৃশ্য দ্যাখাতে নিয়ে আনবেন কিনা। কিন্তু তিনি তা করলেন না। কিছুক্ষণ পর তাদের হাসিও বন্ধ হল। সবকিছুরই একটা লিমিট আছে। মানুষ কেন, পাগলেও একটানাভাবে হাসতে পারবে না। এই যে আবার একটা ভুল কথা বলে ফেললাম। পাগল কি মানুষ না...?
আমি ইমার দিকে তাকিয়ে আছি। তার ঠোঁটে এখনও হাসি, সামনের দাঁত দুটো নেই, তার হাসি দ্যাখলে আমারও হাসি আসে।
ইমা।
জি ভাইয়া।
গতকালের অংক দুটা করেছিলে?
উঁহু।
আমি সরুচোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, কেন?
সে দার্শনিকের মতন গম্ভীর গলায় বলল, এত পড়াশুনা করে কি হবে? শেষমেশ তো সাবিলা আপির মতো বিয়ে করে কোনও লেখকের সাথে ঘর বাঁধব। অবশ্য বাবা বলেন, লেখকদের টাকাকড়ি কম, তাদের সাথে থাকতে হলে নাকি রাজ্যের কষ্ট নিয়ে থাকতে হবে। তাই হয়তো আমাকেও চাকুরি করতে হবে, কি বল তুমি?
আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। ছোট ছোট মেয়েগুলো এত বড়ভাবে কথা বললে রক্ত উঠারই কথা। পড়া নেই, লেখা নেই, সামনে আবার দুটা দাঁতও নেই; এরইমধ্যে আবার বিয়ের পরবর্তী আলোচনা। আমার ভেতর সামান্য অপমানবোধও কাজ করছে। আজকালকার ছোট ছোট বাচ্চাদেরকেও লেখকদের থেকে দূরে থাকবার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এটা অন্যায়, এটা স্পষ্টত দেশদ্রোহিতা।
আমি কড়াচোখে ইমার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি পড়ায় ভালো না হলে কেও তোমাকে বিয়ে করবে না বাবু।
ইমা আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকরভাবে ভেঙ্গচি কেটে বলল, বাবু! কে বাবু? কাকে তুমি বাবু বলছো? যত্তসব! এই শোনো, একটা ভালো কথা মনে করিয়েছো। সেদিন দ্যাখলাম, একটা বড়ভাইয়া রিকশায় তার পাশে বসে থাকা একটা বড় আপুকে 'বাবু' বলছে। তুমি আমার মতো ছোট মেয়েকে বাবু বলো, আবার বড়রা বড়দেরকেও বাবু বলে, এসব কি শুনতেছি...!
আমি হতভম্ব মুখে ইমার দিকে তাকিয়ে আছি। ছোট মেয়ে হলেও তার চিন্তা যুক্তিযুক্ত। এক সময় 'বাবু ' বলতে ছোট বাচ্চাদের বুঝানো হতো। যুগের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিবর্জন, পরিশোধনে একসময় আচরণগতভাবে ছোটদের ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহৃত হত। হিন্দুরা তাঁদের বাবাকে বাবু বলে। কালের বিবর্তনে এখন তা তরুণ-তরুণীদের ক্ষেত্রেও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কথাটা বড় সামান্য নয়। ভাবিলেই আশ্চর্য হতে হয়। সেদিন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। একটা দুইবছরের বাচ্চা ছেলেকে 'উম্মাহ আমাল বাবুতা' বলে একটা তরুণী হৈ হৈ করে জড়িয়ে ধরল। খুব সম্ভব তিনি বাচ্চাটার খালা শ্রেণীর। মেয়েটার পাশে তার প্রেমিক দাঁড়ানো ছিল। মেয়েটা বাচ্চাটার গালে শব্দ করে একটা চুমু খেল। বাচ্চাটার মুখে পবিত্র হাসি। সে চোখ বড়বড় করে মেয়েটার দিকে মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা তার প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, বাবুটা কি সুন্দর, তাই না বাবু...? বাবু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। সে কনফিউজড, তাকে বাবু বলা হয়েছে, আবার বুড়ো একটা ছেলেকেও বাবু বলা হয়েছে। এই পৃথিবীতে কত বিচিত্র জিনিসই না ঘটে! বড় হলে সে এমন একটা কৃত্রিম পৃথিবী পাবে। বাচ্চাদের জন্য একটা সুন্দর, নির্মল, ভেজালমুক্ত পৃথিবী গড়ে যেতে না পারার দুঃখ, আমার কোনওদিনও যাবে না।
আমি রাগী রাগী গলায় বললাম, ইমা, তুমি পড়।
মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বলল, উঁহু! আচ্ছা ভাইয়া শোনো... তার গলা খাদে নেমে এল, সে চুপিচুপি আমার কানের পাশে তার মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, আচ্ছা ভাইয়া, বাবু কিভাবে হয়?
আমি হকচকিয়ে গেলাম। ভালো ঝামেলায় পড়ে গেলাম। আজ খুব সম্ভব, আমার 'ব্যাড ডে' (Bad Day)। সবকিছুই আজ শত্রুর মতন আচরণ করছে। মেয়েটাকে এখন জীববিজ্ঞান বোঝানো যাবে না। আকাশ থেকে বাবু আসে বললেও সে মানতে চাইবে না। কি বলব ভেবে উঠতে না পারার আগেই ইমা বলে উঠল, সেদিন কি হয়েছে জানো? আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে। আমার বান্ধবী না, সহপাঠী। আমি সবাইকে বান্ধবী বানাই না। মেয়েটা সেদিন খুব করে কাঁদল। ঠিক তখনি একটা ছেলে তার গালে চুমু খেল। সে দুদিন স্কুলে আসে নি। পরে যখন আসল, তখন সে বলল, তার নাকি বাবু হবে। সে নাকি কোন বইয়ে পড়েছে, একটা মেয়ের কাঁদার সময় কোনও ছেলে তার গালে চুমু খেলে মেয়েদের বাবু হয়। কথাটা কি সত্য ভাইয়া...?
আমি প্রতিদিন বেত এনে পড়াই। না মারলেও বেত দিয়ে ভয় দ্যাখাই। আজ বাথরুমে আছাড় খাওয়ার পরে বেত আনতে ভুলে গেছি। আমি দাঁতমুখ কুঁচকে বললাম, এসব ফালতু কথায় বিশ্বাস করবে না। গালে চুমু খেলে বাচ্চা হলে বাঙলাদেশের জনসংখ্যা থাকতো দুইশ কোটি। চুপ করে পড় তুমি।
ইমা খুব খুশি হয়ে বলল, সত্যি?
হুম।
ইমা জোরে জোরে ডাকল, সোমা এই সোমা, এদিকে আয়।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ভেতরের রুম থেকে একটা পিচ্চি মেয়ে চলে এল। ইমা বিজয়ের দৃষ্টিতে সোমার দিকে তাকিয়ে বলল, শোন, গালে চুমু খেলে বাবু হয় না। ভাইয়া বলেছে। ভাইয়া সব জানে।
সোমা আমার দিকে আশার চোখে তাকিয়ে বলল, সত্যি ভাইয়া?
আমি অবাক গলায় বললাম, হ্যাঁ।
সোমা একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকে খুব নিশ্চিন্ত দ্যাখাচ্ছে। সে গর্ভবতী হওয়ার টেনশনে ছিল। আমি তার টেনশনটা দূর করলাম। ঠিক এমন অসময়ে আন্টি হাসিমুখে নাস্তা নিয়ে চলে এলেন। তিনদিন পর নাস্তা এনে তার চোখেমুখে বিজয়ের হাসি। যেন ছেলে টিউটরকে নাস্তা দেয়াটাই অনেক বড় ভালো কাজের উদাহরণ, টাকা দেয় এই তো বেশী। ছেলেদের আবার এত নাস্তা কিসের? তারা টঙে বসে পকেটে টাকা থাকলে চা-সিগারেট খাবে, মেসে গিয়ে যদি দ্যাখে ভাত আছে -তাহলে খাবে, নইলে উপাস। ছেলেদের এত শখ থাকতে নেই। শখ হচ্ছে ছেলেদের বিপরীত শব্দ। আন্টি আমার সামনে নাস্তা রাখতে রাখতে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, কি নিয়ে কথা হচ্ছিল? আর সোমা মা, তুমিও কি ভাইয়ার কাছে পড়বে নাকি?
আমি ব্যস্তভাবে কিছু বলার আগেই ইমা ফাঁকা দাঁত দ্যাখিয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, আম্মু জানো, ভাইয়া আমাদের বাবু কিভাবে হয়, তা শিখাচ্ছেন। সোমার বাবু হবে কিনা তাও বলেছেন। তুমি বলেছিলে না, আমি হাসপাতাল থেকে এসেছি। এটাও মনে হয় সত্য না। চুমু খেলে বাবু হয় না, ভাইয়া বলেছে। তাহলে হাসপাতাল থেকে কিভাবে বাবু আসবে? ভাইয়া, আম্মুকে তুমি বলো তো, হাসপাতাল থেকে বাবু আসে কিনা।
আন্টির চোখমুখে এতক্ষণ হাসি লেগে ছিল। তা এখন ক্রমশই রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। আমার পা অসাড় হয়ে আসছে। আজকে আমার আসলেই ব্যাড ডে।
* ৩য় পর্ব
আমি একটা ভাল রকমের শিক্ষা পেয়েছি। আর কখনওই ছোট মেয়েদের টিউশনি হাতে নিব না, ভুলভাবে হাতে নিয়ে ফেললেও, দু'হাত নিমপাতার সাবান দিয়ে ধুয়ে ফকফকে করে ফেলব। পিচ্চি মেয়েগুলো যদি প্রশ্ন করে, আচ্ছা ভাইয়া, বাবু কিভাবে আসে? তাহলে নিজেকে সংযত রাখা কষ্টকর হয়ে যায়। আমি করুণ চোখে আন্টির চোখের দিকে তাকিয়ে কচকচে পাঁচটা পাঁচশ টাকার সেলারী দ্যাখছি। আন্টির চোখ লাল হয়ে গেছে। নির্মলেন্দু গুণের 'তোমার চোখ এত লাল কেন' কবিতাটার কথা মাথায় চলে এল। আন্টির দিকে তাকিয়ে বত্রিশটা দাঁত বের করে কবিতাটা পাঠ করব কিনা তাই ভাবছি। আমার মনে হয় না, তার কোনও প্রয়োজন আছে। আন্টি যদি মাঝপথে চরম একটা ধমক দিয়ে বসেন, তাহলে বাচ্চা দুটোর সামনে আত্মসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ইমু।
আমি খুবই মিষ্টি করে হেসে বললাম, জি আন্টি?
তুমি ইমাকে কয় সাবজেক্ট পড়াও?
যত সাবজেক্ট সে স্কুলে পড়ে।
বায়োলজি কি ক্লাস টুতে আছে?
জি না।
তাহলে তুমি কি আদিম কালের সক্রেটিসের মতো সব বিষয়ে বাচ্চাদের জ্ঞান দিচ্ছো কেন...?
আমি মাথা নিচু করে রইলাম, কোনও জবাব দিলাম না। আন্টি ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না, অথবা ধরতে পেরেও তিনি কাটা গাঁয়ে নুনেরছিটে দিতে আরও বললেন, সেদিন ইমা আমাকে এসে বলল, তুমি নাকি মানবদেহের অতি নিম্নতর অঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছো। তুমি ইমাকে 'পাছা' বলা শিখিয়েছ। এটা কি অন্যায় নয়?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মনে করার চেষ্টা করতে করতে বললাম, আমি তো কোনওদিন এমনটা শিখিয়েছি বলে মনে পড়ে না। কি বললেন এটা?
তোমার মনে না পড়লেও আমার পড়েছে। ইমা মেয়েমানুষ, তুমি ছেলে হয়ে আজ তাকে পাছা বলা শিখালে, কাল শিখাবে অন্য আরেকটা। আমি প্রথমে তোমাকে ছাড় দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এখন তাকে বাবু জন্মের প্রসেস হাতে কলমে শেখাচ্ছো, এসব কি চলছে? আগের টিউটরকে বাদ দেয়া হয়েছে তার চরিত্রগত ত্রুটি থাকার কারণে। তিনি অতি জঘন্য চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বান্দরবনের পাহাড় নাকি মেয়েরা শরীরে বয়ে চলে। আমি তোমাকে ভাল ভেবেই মেয়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম, লেখক মানুষ, মনভোলা। এতকিছুর দিকে মন নেই, বোকাসোকা, তবে জ্ঞান আছে। তাতেই আমার সই। মেয়ে পড়বে আর ভাল কিছু শিখবে। মাস শেষে তুমি টাকা নিয়ে তামাক খাবে আর হুক্কুর হুক্কুর করে কাশতে কাশতে ফার্মেসি থেকে কাশির সিরাপ কিনে ঘরে ফিরবে। এখন দ্যাখছি তুমিও অতি নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী। ছোট মেয়েকে পাছা শিখাচ্ছো। ছি ছি!
ইমা আমার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যস্তভাবে আম্মুর দিকে তাকিয়ে সত্যটা বলে দিল, আম্মু, পাছা না তো, ভাইয়া বলেছিল, চার পাছা বিশ, পাঁচ পাছা পঁচিশ। পাঁচের নামতা।
মূর্খ ভদ্রমহিলা চোখমুখ গরম করে উত্তেজিত হয়ে বললেন, তুই চুপ কর। অই একই কথা! শোনো ইমু, বাচ্চা মানুষকে যেমন শেখাবে, তেমন শিখবে। পাঁচের নামতা অন্য কোনওভাবে শেখাও। দরকার হলে শেখাবাই না। পাঁচের নামতে শেখাতে গিয়ে আবার পাছায় নামলা কেন -বুঝলাম না। পাঁচ থেকে যদি বাচ্চা মেয়ে পাছা শিখে, তবে সেটা শেখানোর চাইতে মূর্খ থাকা ঢের ভাল। বুঝেছো?
আমি শান্ত গলায় বললাম, বুঝেছি।
আর বাবু আসার প্রসেস শেখাচ্ছো কেন?
ইমা আবার ব্যস্ত ভাবে বলে উঠল, মা, আমিই আসলে বলেছিলাম, বাবু কিভাবে আসে? আসলে সোমার ঘটনাটা তো তুমি জানোই। তার চিন্তা দূর করার জন্য বলছি। আমার দোষ। তবে আমি এতে কোনও দোষ দ্যাখি না। বাবু হওয়াটা কি খারাপ মা?
মা প্রচণ্ড রেগে বললেন, খুব খারাপ। এগুলা জানার চেষ্টা করবে না।
ইমা মাথা নিচু করে অভিমানী কণ্ঠে মিনমিন করে বলল, তারমানে আমি খারাপ, তাই না মা?
আমি হাসি মুখে বললাম, না ইমা। তুমি খারাপ না। বাবুরা খুবই পবিত্র। বাবু আসার পদ্ধতিটাও ভালবাসাময়।
ইমা খুশি হয়ে চোখ বড়বড় করে বলল, জানো ভাইয়া, সেদিন ক্লাসে ম্যাম 'Love' শব্দটার অর্থ শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই পৃথিবীতে 'ভালবাসা' সবচাইতে দামী শব্দ। এখন তো তুমিই বললা, বাবু আসার পদ্ধতিটা ভালবাসাময়। তারমানে বাবু আসার পদ্ধতিটা পৃথিবীর সবচাইতে দামী পদ্ধতি। ভাইয়া বল বল, পদ্ধতিটা কি?
এবার সোমাও যোগ হয়ে বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল, হ্যাঁ ভাইয়া বল বল। চুমু খেয়ে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। মুরগী দ্যাখলে আমার খুব ভয় করে, তবে চুমুর ভয় সবচাইতে বেশী। আমি এখন থেকে পৃথিবীতে সবচাইতে বেশী ভয় পাই, চুমুকে। তুমি এবার ভালো করে বুঝিয়ে দাও তো, কিভাবে বাবু আসে।
বাচ্চা দুটা অধীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন অই কথাটা আমি না বললেও চলত। কেন বলেছিলাম, তা নিজেও জানি না। আন্টি আবার চোখমুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে না বলেছি, কথা কম বলতে?
আমি মাথা নিচু করে কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললাম, জি না, বলেন নি।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তখন মানা করে দিলে এই অঘটনটা আর ঘটতো না।
৩.
সাবিলা আমাকে ফোন দিয়েই কাঁদতে থাকল। আমি চুপ করে তার কান্না শুনছি। কান্না শোনার সময় আমার ভেতর খুব করে কান্না পায় না। পেলেও হাসি হাসি মুখে সেই কান্না হজম করতে পারি। সাবিলা কান্না করতে করতে বলল, জানো, আম্মু না আব্বুর সাথে তিতিরের বিয়ে দিয়ে দিবে।
আমি হাসিমুখে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। তা কবে হচ্ছে? কার্ড ছাপানো হয়েছে?
সাবিলা চমকে উঠল। সে এমন জবাব আশা করে নি। তার ভেতরে অপ্রত্যাশিত ব্যাপারগুলো সহজে গ্রহণ করার মতো মন সৃষ্টি হয় নি। সে রেগে উঠে বলল, কি বললা তুমি?
আলহামদুলিল্লাহ। তা কবে হচ্ছে? কার্ড ছাপানো হয়েছে?
তুমি বুঝতে পারছো, ব্যাপারটা কত সিরিয়াস? আমি যাকে এতদিন বান্ধবী ভেবে আসছি, এখন তাকে মা বলে ডাকতে হবে।
ভালই তো। নতুনত্ব আসা উচিত। আচ্ছা, তুমি কি বিবর্তনবাদ পড়েছো?
ফাযলামি বন্ধ।
বিবর্তনবাদ ফাযলামির কোনও ইস্যু না, সিরিয়াস টপিক। ডারউইন ভাইয়া বলেছেন, আমরা আগে বানর ছিলাম। লক্ষ, কোটি বছরের মিউটেশনের ফলে আজকের মানুষের আকৃতি পেয়েছি। ভবিষ্যতেও কি আমরা এমনিই থাকব...? শোনো একটা সত্য ঘটনা বলি, বেশ অনেক বছর আগে জার্মানির এক জার্নাল বলেছে, একবার তারা এক গর্ভবতী নারীর ডেলিভারি করাচ্ছে। ডেলিভারি শেষে সবারই আগ্রহ থাকে বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে, এনিয়ে জামাকাপড় কেনার। কিন্তু ডাক্তাররা অবাক হয়ে দ্যাখলেন, নারীটার পেট থেকে একটি লোমশ আকৃতির দানব বেরিয়ে এসেছে, যার চোখ দুটো অবিকল মানুষের মতো, কিন্তু শরীরটা অন্য কোনও অজানা প্রাণীর। ডাক্তাররা চমকে উঠলেন। এটা ঘটার কথা ছিল না, কিন্তু এই অলৌকিক ব্যাপারটাই বাস্তব। এই প্রাণীটাকে কি করা যায় কি করা যায় -ভাবতে ভাবতে তারা ডিসাইট করলেন, একে মেরে ফেলবেন, কারণ, প্রাণীটা মানুষের মতন আমাদের শহরে বাস করতে পারবে না। আবার প্রাণী হয়ে বনেও যেতে পারবে না। কারণ প্রাণীটাকে কোনও প্রাণী জন্ম দেয় নি, মানুষই জন্ম দিয়েছে। প্রাণীটাকে ডাক্তাররা মেরে ফেললেন। মৃত্যুর আগে নাকি প্রাণীটা অস্ফুটভাবে কিছু একটা বলেছিল, হয়তো মা মা বলে ডেকেছিল। তাকে ফ্লোরে বসিয়ে লোহার রড দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। মৃত্যুর আগে সে মায়ের পেটে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে উঠে বসেছিল। মায়ের বুকের দিকেও হাত বাড়িয়েছিল। মা তখন অজ্ঞান। মা মৃত্যুর আগে সন্তানকে দ্যাখতে পারেন নি। এই যে তোমাকে যা বললাম, তা নিয়ে জীববিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলেছেন, এখন আমরা মিউটেশন করে হয়তো অন্য প্রাণীতে কনভার্ট হতে পারি। তার জন্যও বোধহয় লক্ষ বছর সময় লাগবে। এটা হলো নতুনত্ব। তাই আমাদের নতুনত্বের পূজা করতে হবে। তুমিও বান্ধবীকে মা ডেকে নতুনত্বের পূজা করো। শুভ কামনা রইল।
সাবিলা চুপ করে আছে। তার একটা কমন ডায়ালগ হচ্ছে- তোমাকে যদি সামনে পেতাম! এখনও বোধহয় সেটাই ভাবছে। আমি তার সামনে নেই বলে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। সাবিলা কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবছে, আমার সাথে আর কোনও কথা বলা উচিত, কি অনুচিত। আমার মতো প্রাণীর সাথে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে কতটুকু ফায়দা হবে তাও ভাবছে। মোবাইলে বিল উঠছে। সাবিলা ফোন রেখে দিল। ফোন রাখার আগে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করল, কিন্তু কোনও কথা বলল না। প্রেমিকা তার চোখের জল প্রকাশ্য করার জন্য প্রেমিকের কাছে ফোন দেয়। প্রেমিকরা কখনওই একাজটা করে না। কারণ ছেলেরা কাঁদলে মানুষ হাসতে হাসতে বলে, বুড়া ছেলে আবার কাঁদেও!
আমি ফোন হাতে বসে আছি। কাকে ফোন দেয়া যায় ভাবছি। ভদ্রমহিলা আসলেই তার স্বামীর বিয়ে দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটা বন্ধ না হলে মহিন সাহেবের সব সম্মান মাটিতে মিশে যাবে, এটা ঠিক হবে না। মহিন সাহেব ভদ্র মানুষ। আমি সাবিলার মাকে ফোন দিলাম। তিনবার রিঙ হতেই তিনি বেশ নরমসুরে বললেন, বাবা ইমু।
জি আন্টি, আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। শোনো বুড়োটা আসলেই জাত বদমাশ! তোমার কথা কারেক্ট। ওর বিয়ে দিয়ে দিব। পাত্রীর নাম তিতির। মেয়েদের এখানে সেখানে হাত দেয়ার অভ্যাস বন্ধ করে দেয়ার জন্য বুড়ো বয়সে একটা কড়া শাস্তির প্রয়োজন। কি বলো?
তা তো অবশ্যই। আন্টি আপনাকে আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। আজকালকার ছেলেগুলো খুব বদমাশ! কথায় কথায় তো আকাশের তারা, ফোন দিয়ে একবারও সালাম দেয় না। তুমি অনেক লক্ষ্মীটি! প্রতি কথায় সালাম দাও।
জি শোকরিয়া।
শোনো বাবা, তুমি বদমাশটার সব অপকৃতিগুলো সামনে আনো। প্লিজ বাবা। আর কোথায় কি করে, তা প্লিজ জানাও।
জি তা তো জানানোর জন্যই ফোন দিয়েছি। তবে দুটা শর্ত আছে।
কি শর্ত বাবা?
আগে বলেন মানবেন?
হুম।
আজকের জন্য তিতিরের সাথে বিয়ে স্টপ করে দেন।
তিনি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, দ্বিতীয় শর্ত...?
* ৪র্থ পর্ব
প্রেমিকার মুখ থেকে তার মা সম্পর্কে একটা সত্য শুনেছি। সত্যটা হল, মহিলা হালিমের লবণ টেস্ট করতে করতে পাতিলের সব হালিম খেয়ে ফেলেন। এই ধরনের মহিলাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখলে বিপদ অনিবার্য। আমি দ্বিতীয় শর্তটা বলব কিনা ভাবছি। ওপাশে ভদ্রমহিলা শান্ত গলায় বললেন, দ্বিতীয় শর্ত?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আগে প্রথম শর্ত পালিত হোক, তারপর দ্বিতীয় শর্ত।
আমি ফোন রেখে দিলাম। মাথা কিছুটা ধরে আছে। মাথা ধরা ছাড়ানোর জন্য জহিরের টি-স্টলে চা খেতে হবে, দুধ-চিনি বেশী দিয়ে চা। মাথা ধরা কমে যাবে। চা খেতে বের হলাম। আবহাওয়া বেশ ভাল আজকে। বসন্ত না হলেও চারপাশে বসন্তী উৎসব। এখন বাঙলা কি মাস চলছে, জানা নেই। বাঙালীরা বাঙলা মাস ছাড়া বাকি সবকিছুই মনে রাখতে পারে। আমার মতে, বাঙলা মাসের আদৌ কি দরকার ছিল...? শুধু পহেলা বৈশাখ, আর পহেলা ফাল্গুন মনে রাখার জন্যই কি আমরা লাফালাফি করে বাঙলা মাস বাঙলা মাস বলে চিল্লাই? জানি না।
চায়ে চুমুক দেয়া মাত্রই ফোন এল। সিগারেট খাওয়ার সময় ফোনে কথা বলতে বিরক্ত লাগলেও চা খাওয়ার সময় ফোনে কথা বলতে বেশ ভালই লাগে। সাবিলা ফোন দিয়েছে। তার রাগ ক্ষণস্থায়ী, নিশ্চয় রাগ ভেঙে গেছে। আমি চায়ে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে বললাম, Hi.
সাবিলা অবাক হয়ে বলল, তুমি হাই দিচ্ছ কেন? কখনও তো এমনটা বল না, আজ কি হয়েছে তোমার?
নাথিং!
সাবিলা রাগার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে রাগতে পারল না। নিজেকে ভালবাসার ফুল বানিয়ে মিষ্টি করে বলল, তোমাকে অনেক থ্যাংকস। বিয়েটা ভেঙে গেছে। শেষ মুহূর্তে আম্মুর রাগ পড়ে গেছে। আব্বুকে মাফ করে দিয়ে তিতিরকে দুটা বকা দিয়ে সব খালাশ করে দিয়েছে। তুমি আসলেই একটা জিনিয়াস!
থ্যাংক ইউ।
সাবিলা ভ্রু কুঁচকে বলল, ওমা! কি হয়েছে তোমার? কখনও তো এভাবে কথা বলো না। থ্যাংক ইউ তো দাওই না। আজ কি হয়েছে। বাঙলা খাচ্ছ? তুমি কি কোনও চিপাগলিতে?
না।
তাহলে?
জহিরের দোকানে।
থ্যাংকস গড! অসব বাঙলা-টাঙলা আবার খেয়ো না কিন্তু, অসুখ করবে।
আচ্ছা।
তুমি এত সংক্ষিপ্ত আনসার দিচ্ছো কেন? রাগ করেছো আমার উপর?
রাগ কেন করব?
হ্যাঁ, তাই তো। আচ্ছা রাখি। কখন দ্যাখা করবে জানিয়ো।
জানাব।
বেশ কিছুদিন ধরে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হলো: কোন জিনিশ যত বড় হয়, তত ছোট হয়। অনেকেই একেকরকম আনসার দিচ্ছে। মনোমতো হচ্ছে না কোনও উত্তরই।
ইমার বাসায় পড়াতে এসেছি। অজানা কারণেই মন বিষণ্ণ। মানুষের মন সবকিছু মনে রাখতে সক্ষম। কিন্তু আমরা যখন মনের কথা ভুলে যাই, তখন বুঝতে হবে, আমার ভেতর এখন আর সেই মনটি নেই। থাকলেও তা আমাদেরকে মনে করাতে অনিচ্ছুক। কেন আমার মন বিষণ্ণ। মন আমাদেরকে অনেক সাপোর্ট দিয়ে চলে, অথচ আমরাই মনের সাথে বেইমানি করি। নিজের মনে নিজেদের কথা না ভেবে অন্য কাওকে ভাবি, যার আমার কথা মনেই পড়ে না।
ইমা আজ ভীষণ চুপচাপ। তার খুব সম্ভব মন খারাপ। তার মন ভাল করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয় নি। আমি কড়া গলায় বললাম, পড়া তৈরি করেছো?
সে মিনমিন করে বলল, না।
কেন?
ইমা নিশ্চুপ। কখনও যেকাজটা করি নি, আজ তাই করলাম। বেত দিয়ে ঠাস করে একটা লাগিয়ে বললাম, কেন?
ইমার চোখে জল চলে আসছে। আমি কখনওই তার সাথে এমন আচরণ করি নি, আজ করার পেছনের কারণটাও ছোট হওয়ার কারণে সে ধরতে পারছে না। তবে উপলব্ধি করতে পারছে, আমার মনমেজাজ ভালো নেই। ঠিক এমন অসময়েই আন্টি ছুটে এল। তিনি অবাক হয়ে বললেন, বাচ্চা মেয়ের গায়ে কেও হাত তোলে?
অথচ বেশ কিছুদিন পূর্বে তিনিই বলেছিলেন, বাবা, এমন মার মারবা, যেন তোমার ভয়েই সব পড়া শিখে নেয়।
ইমাকে পড়িয়ে বের হলাম। আরেক জায়গায় নূতন টিউশনির জন্য ফোন এসেছে। সিগারেট টানতে টানতে সেই জায়গায় যাচ্ছি।
ছাত্র বা ছাত্রীর বাসায় আসার পর তিনবার কলিংবেল বাজালাম। খোলার কোনও নাম নেই। এমনটা হলে অসহ্যই লাগে। সাতবার কলিংবেল বাজানোর পর এক গম্ভীর ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। তেজি গলায় বললেন, টিউশনির জন্য এসেছো?
জি।
আসো।
আমি আসলাম। ঘরের এককোণে সোফায় বসে রইলাম। বেশ সুন্দর করে সাজানো একটা সংসার। অন্যরুমে কার্ভ টিভি (Curve TV) দ্যাখতে পাচ্ছি। টাকা জমিয়ে আমারও একটা কার্ভ টিভি কেনার খায়েশ আছে। আমার মাথার উপরে রবীন্দ্রনাথ ঝুলছেন। সামনে একটা অতি সুন্দরী বালিকা মোবাইল চালাচ্ছে অবিরাম। আমি যে একজন মেহমান, এবং আমি বাসায় আসার পর যে সামান্য চা-নাস্তার আয়োজন করতে হয়, কথা বলতে হয়, তার সেই হিউমার সেন্স তৈরি হয় নি। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন মহিলা আসলেন। তার চুলগুলো বেশ সুন্দর, বনলতা সেন। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, বাবা, ভাল আছো?
জি আন্টি।
তুমি তো মনে হয়, অনেক জায়গায় পড়াও।
জি আন্টি।
আমি শুনেছি, তুমি ভাল পড়াও। বাবা, আমার একটাই মেয়ে। নাইনে পড়ছে। চার বিষয়ে পড়াবে। এটা আমার মেয়ে।
আমি রুমে অন্যপাশে বসে মোবাইলে ব্যস্ত থাকা মেয়েটার দিকে তাকালাম। আন্টি হাসি হাসি মুখ করে বললেন, বাবা, কত দিব?
আমি মুখে মধুর হাসি এনে বললাম, চার হাজার।
আন্টি মনে হয়, ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন, এত্ত!
জি।
বাবা, বলতে লজ্জা লাগছে, তোমার কথা আমি অনেক শুনেছি। তোমাকে ফিরিয়ে দিব না। তবে বাবা একটু কম হলে ভাল হতো। আমরা আসলে অতটা অবস্থা সম্পন্ন নই তো! ওর বাবা মাসে সামান্য অর্থই ইনকাম করে। যদি একটু কন্সিডার করতে...
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, আপনারা গরীব?
জি বাবা।
তাহলে আংকেলকে যে আমি বেশ কিছুদিন ধরে মিরপুরে কার নিয়ে চলতে দ্যাখি! আপনাদের বাসা কার্ভ টিভি আছে, যার বাজারমূল্য ৫২ হাজার টাকা, মেয়ের হাতে আইফোন সিক্স, মাথার উপরে এই যে রবীগুরু -এটারও তো বিশ হাজারের উপর দাম আছে। তবুও টিউশনি টিচারের বেতন দেবার কালে আপনারা গরীব, তাই না?
আন্টি প্রায় হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তিনি এমন জবাব আশাই করেন নি। তার নিজেকে এভাবে বোঝাতে কষ্ট হচ্ছে যে, কথাগুলো আমিই বলেছি। আজ মেজাজ গরম, আমি চলে এলাম। আসার আগে দ্যাখলাম, ছাত্রী একবার অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
সাবিলার আম্মু ফোন করেই বললেন, বাবা ইমু।
জি আন্টি। আপনাকে আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। বাবা, ভাল আছো?
জি আন্টি।
বাবা শোনো, সাবিলার বাবা তো আরেকটা অঘটন ঘটিয়েছে।
কি অঘটন?
পাশের বাসার কুমকুম ভাবি গতকাল তার কাপড় ছাদে দিয়েছিলেন শুকাতে। বিকেলে কাপড়চোপড় আনার সময় দ্যাখলেন তোমার লুচ্চা আংকেল অইখানে দাঁড়িয়ে। ভাবিও কি জানি না, মিষ্টি করে হেসে হেসে কথা জমাল। এরপর কাপড়-চোপড় আনার সময় দ্যাখে তার লাল রঙের ব্লাউজটা নাই। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজা-খুঁজির পর তা কোথায় পাওয়া গেল জানো?
কোথায়?
তোমার আংকেলের প্যান্টের পকেটে। এখন তার মেয়েদের ব্লাউজ শুঁকে দ্যাখার বদ ইচ্ছা জেগেছে। আমি একে নিয়ে কি করব বাবা, তুমিই বল।
আন্টির গলা ভারী হয়ে আসছে, তিনি আমার সামনে কাঁদতে পারছেন না। কিন্তু একটুপর কেঁদে ফেলবেন নিশ্চিত।
আমি খুব শান্ত গলায় বললাম, এরপর কি হয়েছে? ব্লাউজটা কি বের হয়েছে?
আন্টি ধরা গলায় বলল, না বাবা। তোমার আংকেল ওটা দিতেই চায় না। মেয়েদের ব্লাউজ নিয়ে তার অনেক ক্ষুধা। এখন যদি রোজরোজ পাশের বাসার ভাবীদের ব্লাউজ চুরি হয়ে যায়, তাহলে আমাদের আর এই বাসায় থাকতে হবে না।
* ৫ম পর্ব
আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। চিন্তায় পড়ে যাবার মতনই ইস্যু। মেয়েদের ব্লাউজ চুরি করা ক্ষমার অমার্জনীয় অপরাধ। মহিন সাহেবকে এতদিন ভাল মানুষ হিসেবে জেনে এসেছি। এখন তার উপর থেকে সমস্ত বিশ্বাস উড়ে গেছে। ওপাশ থেকে আন্টি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, বাবা, তোমার আংকেলের চুরি করার মধ্যেও একটা ধারা আছে। যেমন- সে লাল, শাদা আর নীল রঙের ব্লাউজ ছাড়া অন্যকোনও ব্লাউজ চুরি করবে না। তার কাছে এই তিনটে রঙই নাকি উত্তেজক বর্ণ! ব্লাউজ চুরি করে আমাকেও তো দেয় না, রাত হলেই দ্যাখি বেটা অই ব্লাউজগুলো হাতে নিয়ে শুঁকে শুঁকে দ্যাখে। কেমনতর মানুষ এবার দ্যাখো! আর তুমি বল, এর আরেকটা বিয়ের দরকার নেই? অবশ্যকরণীয়! না করলে বুড়াটা বাঁচবে না। বাবা দ্যাখলা, পুরুষ মানুষ কেন অমানুষ? পুরুষজাতি বৌ মারা গেলে তারা পরদিনই আরেকটা বিয়ে করে হাসিমুখে নতুন বৌয়ের এখানে-সেখানে চুমু খায়। কিন্তু মেয়েরা হলো মায়ের জাতি। হাজারটা বাঁধার পরেও তারা একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়। বাবা, এখনই তুমি আমার বাসায় আসো। নগদে দ্যাখাব বুড়াটার অপকীর্তি।
আমি বিপদে পড়ে আছি। নগদে মহিলার বাসায় গেলে কোনও সমস্যা হবে না। ইদানীং টাকাপয়সা হাতে নেই, তবে যথেষ্ট সময় আছে। সময় এবং টাকাকে একসাথে পাওয়া গেলে বেশ হয়। কিন্তু দুটাই যে সাপ আর বেজি; পাশাপাশি থাকতে অনিচ্ছুক।
পাশের বাসা থেকে কোনও সাড়াশব্দ আসছে না। নূতন বিবাহিত দম্পতি উঠেছে পাশের ফ্ল্যাটে। সিরাজ সাহেব হাইস্কুলের গণিতের টিচার। সদ্য বিয়ে করে এসেছেন। লোকে নানান বাজে কথা বলছে। তিনি তাতে মনঃক্ষুণ্ণ হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি সর্বদা মাথানিচু করে চলেন। কারও প্রশ্নের জবাব দিলেও তা খুবই সামান্য কথায়। সবার অভিযোগ দুটা-
১. সিরাজ সাহেব দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
২. পাত্রীর বয়স কম।
জানা গেছে, পাত্রীর বয়স তেরো বছর, পাত্রের বয়স সাঁইত্রিশ বছর।
আমি সাবিলাদের বাসার দিকে যাচ্ছি। জহিরের দোকানে একটা চা আর একটা সিগারেট খেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাব। জহিরের দোকানে ঢুকেই দ্যাখি, সিরাজ সাহেব মাথানিচু করে বসে চা খাচ্ছেন। আমি তার পাশে বসলাম। তিনি তাতে কোনওরূপ ভ্রুক্ষেপ বা অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন না। তিনি বোধহয় একপ্রকার ধরেই নিয়েছেন আমিও তাকে অন্য সবার মতই ঘৃণা করি। আমি চা-তে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, সিরাজ সাহেব।
তিনি আগের মতই মাথানিচু করে বললেন, জি?
জীবনটা ভাল আছে?
আছে।
আপনার স্ত্রী মাশাল্লা অনেক সুন্দরী।
থ্যাংক ইউ।
আমি খুব শান্ত গলায় বললাম, শোনেন ভাই, মানুষ হিংসা ছাড়া কিছুই করতে পারে না। আপনার স্ত্রী সুন্দরী, তাই সবার গা জ্বলে, এসব নিয়ে ভাববেন না। আপনাদের জন্য শুভকামনা। কিশোরী মেয়েরা আবেগী হয়। এই বয়সে জান-প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে। এই ভালবাসাটা রক্ষা করা কিন্তু আপনার দায়িত্ব। মেয়ে বড় হলেই দ্যাখবেন, মেয়ের ইন্টারেস্ট আস্তে আস্তে কমে আসবে। অবহেলা করবেন না তখন, সাবধান! ছোট মেয়েদের ভালবাসা হচ্ছে স্বচ্ছ, একেবারে পিউর। যে ছেলে এই ভালবাসাটা ধরে রাখতে পারে, ডিপ্রেশন তার এবং তাদের বিপরীত শব্দ হয়ে যায়।
সিরাজ সাহেব খুব খুশি হলেন মনে হলো। তিনি আমার দিকে ফিরে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলেন। কৃতজ্ঞতামূলক হাসি। আমি তার দিকে তাকিয়ে কিছুটা গম্ভীর গলায় বললাম, আপনারা কি প্রেম করে বিয়ে করেছেন, নাকি বিয়ে করে প্রেম করছেন?
সিরাজ সাহেবকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা হয়েছে। তিনি এটার উত্তর দিতেও পারেন, আবার নাও পারেন। আমি ততক্ষণে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছি। সিরাজ সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বিচলিত ভঙ্গিতে বললেন, প্রেম করে।
আমার চোখ কপালে উঠে গেছে। এত অসম বয়সের প্রেম হয় কি করে? মনের ভেতর খুঁতখুঁত করছে, ঠিক এমন সময়েই তিনি গম্ভীর মুখে বলতে থাকলেন, অসম বয়স যদিও। তবুও হয়ে গেল। অনেকে বাঁকা চোখে ব্যাপারটাকে দ্যাখে। এটা কি ঠিক? আমাদের প্রাণের রাসূল স. আয়েশা রাঃ -কে যখন শাদি করেন, তখন মা আয়েশার বয়স ছিল ছয় বছর। কম বয়স, তাতে কি! রাসূল করেন নি? এটা কি ইসলামে নিষেধ? বয়স কি ভালবাসার চাইতেও দামী? আমাদের রাসূলের বয়স যখন পঁচিশ, তখন তিনি প্রথম শাদি করেন চল্লিশ বছর বয়স্কা খাদিজার সহিত। রাসূলের মতন এত বড় মাপের মানুষ আমাদের সবমসময় ভালবাসারই শিক্ষা দেন। আমরাই এই ভালবাসা নিয়ে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করি।
আমি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললাম, প্রেমটা হলে কিভাবে?
সে ভাই অনেক বড় কাহিনী। মেয়ে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না, টাইপ। আগের স্ত্রী গত হয়েছে চার বছর হলো। আসলেই আমরা পুরুষেরা একাকীত্ব সহ্য করতে পারি না। মহিলারা তা পারে। স্বামী মরে গেলেও স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে সারাটাজীবন। শ্রী রামানুজানকে তো অবশ্যই চেনেন?
জি।
আমার অংকের শিক্ষক হবার সবচে' বড় কারণ ইনিই। বেশ বড় মাপের মানুষ। তখনকার দিনে ব্রিটিশরা রামানুজানকে তো পাত্তাই দিতে চাইত না। রামানুজানের একটা সমস্যা ছিল। তিনি ঠুসঠাস অংক করে যেতে পারতেন, কিন্তু কাওকে বোঝাতে পারতেন না, অংকটা কিভাবে হলো। ব্রিটিশরা তার বইও ছাপতে অরাজি। কারণ তারা বিশদভাবে ব্যাখ্যা চায়। রামানুজান নিজে বুঝে বুঝে অংক করে যেতেন। কিন্তু কোনটা কোথা থেকে আসল তার ব্যাখ্যা ভালভাবে দিতে পারতেন না। ব্রিটিশরা তাকে পাত্তা না দিলে কি হবে, তার গণিতের সূত্র ধরেই কিন্তু আধুনিক "বিগ ব্যাঙ"। তিনি কিন্তু খুব কম বয়সে মারা যান। যক্ষ্মারোগে ভুগে। কিন্তু তার স্ত্রীর তখনও কাঁচা যৌবন। ইচ্ছে করলেই ভালো জায়গায় শাদি করে সংসারী হতে পারতেন। তবুও তিনি শাদি না করে বাকি জীবনটা রামানুজানকে ভেবে ভেবে কাটিয়ে দিয়েছেন। নারী জাতির মাহাত্ম্যকথা বলে বোঝানো অন্যায়। এঁদের কথা বলতে গেলে কাগজ, কলম ফুরিয়ে যাবে। এঁরা খুবই ভালবাসাময়ী, তবে গাধী টাইপের।
আমি সাবিলার মায়ের সামনে বসে আছি। আমাকে খুব ভালো নাস্তা করানো হয়েছে। সাবিলা বাইরে গেছে। আসতে বেশীক্ষণ লাগবে না। আমি আঙুর খাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আন্টি আমার সাথে শলাপরামর্শ সেরে ফেলেছেন। আংকেল রুমে আসামাত্রই চুপ করে আমার দিকে ফিরে ভদ্রমহিলা মিষ্টি করে হাসলেন। আংকেল মহিন সাহেব আমার সামনে পত্রিকা নিয়ে বসলেন। আমি সালাম দিলাম না। খাদ্য গ্রহণের সময় সালাম দিতে নবীজির নিষেধ আছে। মহিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, তোমার নাম কি ইমু?
জি।
কি করো তুমি?
জি লেখালেখি।
তার মুখ থেকে হঠাৎ-ই হাসিটা উধাও হয়ে গেল। তিনি হতভম্ব মুখে আমার দিকে তাকালেন। আমি লেখক হয়ে তার মেয়ের স্বামী হতে এসে যে বড় ভুল করে ফেলেছি, তা তার মুখ দ্যাখেই বোঝা যাচ্ছে। মহিন সাহেব প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি লেখক?
জি।
তুমি কি ভেবেছো, লেখকদের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিব?
এই বলেই তিনি আমার চোখে চোখ রেখে দাঁতমুখ কুঁচকালেন। আন্টির কাছ থেকে সাপোর্ট পাবার আশায় আন্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, মিরা, তুমি দ্যাখি ওকে কিছু বলছো না! ছেলে লেখক হয়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়! তার সাহস এত বড় হয় কিভাবে? ফকিরের বাচ্চা লেখক কোথাকার! লেখালেখি করে!
আন্টির কাছ থেকে সাপোর্ট নিতে গিয়েই মহিন সাহেব ভুলটা করলেন। স্ত্রী দাঁতমুখ কুঁচকে বললেন, বেশ করে, লেখালেখিই তো করে! অন্তত পাশের বাসার ভাবিদের ব্লাউজ তো আর চুরি করে না।
হঠাৎ-ই মহিন সাহেবের চোখ আমার চোখ থেকে সরে গেল। তার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে বিড়ালের মতো নীল হয়ে গেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে একটা আঙুর মুখে ঢুকিয়ে আরেকটা আঙুর মহিন সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, খাবেন?
মহিন সাহেব শেষবারের মতন আমার চোখের দিকে পূর্বের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল চাউনিতে রাগ প্রকাশ করে বিড়বিড় করে অস্পষ্ট ভাষায় কি যেন বলে চলে গেলেন। আন্টি আবার বত্রিশটা দাঁত বের করে ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দেবার মতো মিষ্টি করে হেসে শলাপরামর্শ চালানো শুরু করলেন আমার সাথে। আমি ভীষণ আনন্দিত হলাম। মহিন সাহেব এখন যা করলেন, তার শাস্তি দেবার ইচ্ছা জেগেছিল তখনই। এখন আন্টি যেভাবে সায়েস্তা করতে পরামর্শ দিলেন এটা আমার বেশ মনে ধরেছে। মহিন সাহেবকে জবর শাস্তির বুদ্ধিটা আন্টি ছাড়া আর কারইবা মাথায় আসবে...?
*৬ষ্ঠ পর্ব
প্রেমিকার বাবা পাশের বাসার ভাবিদের ব্লাউজ চুরি করেন। এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে প্রেমিকার মায়ের মতন দাজ্জাল মহিলাটাও আমার ভালো বন্ধু হয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়। তার মতন কিপটে মানুষটা আমাকে পাঁচ হাজার টাকাও দিয়েছেন। তিনি কেমন কিপটে তা সাবিলার মুখ থেকেই শুনেছি। তিনি নাকি আদা, রসুন বাটার পর হাতে লেগে থাকা আদা, রসুনের অবিশিষ্টাংশ ধুয়ে না ফেলে হাতসুদ্ধই চুলোর উপর থাকা প্যানের উপর কুসুমগরম তেলের মধ্যে চুবিয়ে দেন। এই ভদ্রমহিলাকে এতদিন খারাপ ভেবে আসা আমার অনুচিত হয়েছে। তার আসলে একটা দয়ার শরীর আছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না। তাছাড়া তিনি তার স্বামীকে ভালবাসেন, আর বেচারার কষ্টার্জিত অর্থ অপচয় না করার তাগিদে তিনি যদি সামান্য কিপটে হোন, তবে তাকে 'কিপটেমি' না বলে ভালবাসার ব্যতিক্রম উদাহরণ -হিশেবে দাঁড় করানো যেতে পারে। ভদ্রমহিলা আমাকে আরও পাঁচ হাজার টাকা দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেটা কাজ শেষ হবার পর। কাজটা এখনও আমার মাথায় ঘুরছে। মহিলারই বুদ্ধি।
রেল স্টেশনে বসে আছি। আন্টি যে বুদ্ধিটা দিয়েছিলেন, সেটা নিয়েই ভাবছি। আর সামনে বসে থাকা একটা পাগল মেয়েকে দ্যাখছি। পাগল হলে কি হবে, তার জামাকাপড় যথেষ্টই পরিষ্কার। এমন স্মার্ট পাগল সচরাচর দ্যাখা পাওয়া দুষ্কর। খুব সম্ভব কোনও অর্গানাইজেশন থেকে ভালো কিছু কাপড় পেয়েছে। সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। আমার হাতে কোনও খাবার নেই। একটা সিগারেট আছে শুধু। পাগলকে তা দেয়া যাবে না। সে এটা চিবিয়ে খেয়ে বিপদে পড়বে। পকেটে টাকা থাকলে তাকে কিছু খাওয়ানো যেত। আমার পকেটে মানিব্যাগ নেই। তবে সেদিন ভালো টাকা ইনকাম হয়েছে। আমি এখন পাঁচ হাজার টাকার মালিক। সেই খুশিতে সিরাজ সাহেবের বালিকা স্ত্রীকে একটা নীল শাড়ি কিনে দিয়েছি। মেয়েটার চোখে জল চলে এসেছিল। সিরাজ সাহেব হতভম্ব মুখে তার স্ত্রীর উচ্ছ্বাস দ্যাখেছিলেন। আমার খুব ভাল লেগেছিল।
পাগলটা আমার দিকে তাকিয়ে দুই আঙুল দিয়ে নিজ কপালে দুবার আলতো করে ঘষা দিল। এটা তার বদভ্যাস না আমাকে তার ভাল লাগার নিদর্শন হিশেবে দিয়েছে, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। খুব সম্ভব বদভ্যাস, আমাকে ভাল লাগার কোনও কারণ নেই। বর্তমানে সব ছেড়েছুঁড়ে লেখক হবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমি আত্মহত্যা করেছিলাম বলেই হয়তো লেখক হবার সিদ্ধান্ত নিই। সবার আত্মহত্যা করার সাহস নেই। দরকার নেই বলেই হয়তো-বা। 'কি বুঝলেন ভাই?'
আমি পাশ ফিরে তাকালাম। একজন ভদ্রলোক পত্রিকা হাতে বসে আছেন। পত্রিকার দিকে তাকিয়েই তিনি গম্ভীর গলায় প্রশ্নটা করেছেন। পাগল দ্যাখার মধ্যে হয়তো তিনি যৌক্তিক কোনও কিছু খুঁজে পান নি। আমি স্মিত হেসে বললাম, পাগলীটাকে দ্যাখছি।
রোজ রোজ কত মানুষই তো তাকে দ্যাখে, কিন্তু সাহস করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার কথা কেও ভাবে না। পাগলটাও একটা জিনিশ বটে।
কি জিনিশ?
তিনি পত্রিকা থেকে চোখ কপালে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওমা! আপনি জানেন না, পাগলটা কি করে?
কি করে?
নাচে। প্রতিরাতে নাচে। তখন আমোদী পাবলিক গান ছেড়ে দেয়। পাগলটা জান-প্রাণ দিয়ে নাচে। নাচতে নাচতে পড়েও যায়। কেও কেও এসে উঠিয়েও দেয় বটে, তবে পাগলটার স্বার্থে না, নিজেদেরই স্বার্থে। পাগলটাকে তুলে কড়া গলায় বলে, নাচ নাচ। পাগলটাও জান-প্রাণ দিয়ে নাচে। বড়ই নিষ্ঠুর মানুষগুলো!
ব্যাপারটা খুব বেদনাব্যঞ্জক। আমি পাগলীটার দিকে তাকিয়ে আছি। তার জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগত। পাশে বসা ভদ্রলোকটা উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। আমি চোখ বন্ধ করলাম। আজ উনিশে মার্চ। এইদিনটা আমার বিশেষভাবে মনে থাকে। এইদিন আমি ভবঘুরে হয়ে দারুণ এক যাত্রা শুরু করেছিলাম। প্রথমে গিয়েছিলাম লালন সাঁইজির দরবারে। বাবার দরবারে মুরিদ হবার খায়েশ ছিল। বাস যখন রাজবাড়িতে, ঠিক তখনিই সুপ্তিকা ফোন করল। অনেকদিন পর ফোন করল। তার নাকি বাসায় ফোন ধরতে এবং করতে ঝামেলা আছে। সুপ্তিকা আমার তেমন কেও নয়, আমার লেখা তার ভালো লাগে, সেখান থেকেই পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে... না বন্ধুই। খুবই সিরিয়াস মেয়ে। অনেক বেশী বাস্তববাদী। আমার থেকে ক্লাসে একবছরের ছোট, কিন্তু বয়সে দুদিনের বড়। বেশীরভাগ সময়েই ডিপ্রেশনে ভোগে। তার কষ্টের কথাগুলো আমার সাথে শেয়ার করে। আমি খুশি হই তার খুশি দ্যাখে। তার অনেকদিনের ইচ্ছে একটা "ডিপ্রেশন গ্রুপ" খোলার। যেখানে মানসিকভাবে হতাশদের ভালো চিকিৎসা হবে। তার আসল নামটা আমি বলব না, আমিই তার নাম সুপ্তিকা দিয়েছি। কেন দিয়েছি, তাও এক বিশাল কাহিনী, কিন্তু তাকে কখনই তা বলা হয় নি।
কুষ্টিয়া পৌঁছার আগে তার সাথে ফোনে কথা হলেও আমি তাকে কুষ্টিয়া আসার ব্যাপারটি গোপন রাখি। শুধু বত্রিশটা দাঁত বের করে বলেছি, বাসা থেকে পালিয়ে গেছি। সে ছয়শেরও বেশী প্রশ্নবাণে আমাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। আমি প্রতিত্তরে শুধু বলেছিলাম, বাসায় মন টিকছে না, তাই গৃহ পলায়ন।
কুষ্টিয়া এসে লালন বাবার দরবারে এক সাঁইজির আশ্রয়ে রাতে ঘুমানোর মহাসুযোগ হয়। মেয়েটা রাত এগারোটায় ফোন দিয়ে ভাঙা গলায় বলল, তুমি কোথায়?
আমি স্বাভাবিক ভাবে হেসে হেসে বললাম, আমি কুষ্টিয়াতে।
আমি জানি তো।
আমি খুব অবাক হলাম। ব্যাপারটা তার কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। 'কিভাবে জানো?'
মনে হলো তাই। কোথায় তুমি?
আমি বিজয়ের হাসি হেসে বললাম, লালন বাবার দরবারে। এক সাঁইজির কাছে আছি। ভীষণ ভালো মানুষ। কথা বলবে তার সাথে? ফোন দিব তাকে?
সুপ্তিকা ফোন রেখে দিল। আমি সাঁইজির দিকে তাকালাম। তিনি দাঁত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু আগে তিনি নারীর শরীর নিয়ে বেশ মজার মজার কথা বলেছিলেন। শ্রোতা আমি একা নই। আমার সাথে আমার সমবয়সী আরও দুটা ছেলে আছে। তারাও আমারই মতন পর্যটক। আমরা সবাই সাঁইজির কথায় মজা পাচ্ছি। অডিটোরিয়ামে আমরা সবাই বিছানা পেতেছি। বিছানা বলতে ফ্লোরের উপর কাঁথা। অনেক সাঁইজি, মহিলা সাঁইজি শুয়ে আছেন। কেও আবার মনের সুখে তামাক ধ্বংস করছেন। আমি শুয়ে পড়লাম ব্যাগটাকে মাথার নিচে রেখে। ফোন তুলে দ্যাখি সুপ্তিকার আবেগঘন মেসেজ। সে লিখেছে, ইমু, তুমি এমনটা করলে কেন? বাসা ছেড়ে পালিয়েছো কেন? বাসার ঝগড়া মিটমাট করতে পারো নি? এখন তুমি কি খাবা? কোথায় ঘুমাবা? কেন করলে এমনটা? আচ্ছা বাসা থেকে পালিয়ে ঢাকাতেই কোনও বন্ধুর বাসায় থাকতে, লালনের দরবারে কেন এসেছো? আমি তোমাকে কত বারণ করেছি না, জায়গাটা ভাল না ভাল না। তুমি তো শুনলেই না। কেন করলে এমনটা? এখন তুমি কি করবে? এত পাগলামি কেন করো? এত ভবঘুরে না হলে বাঁচা যায় না? তুমি না বলেছিলে কোচিঙে ক্লাস করাবে? কই তোমার কোচিঙ? সেটা ফেলে দরবারে কি করো? আমার তখন খুব কান্না পাচ্ছিল, তাই ফোন রেখে দিয়েছিলাম।
আমি মেসেজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। যাত্রী ছাউনিতেও আমি ঘুমিয়েছি। সুতরাং এই অডিটোরিয়াম আমার কাছে ৩০০ টাকার দামী হোটেল। লালনের দরবার ভাল না -এটা সুপ্তিকা ভুল বলেছে। এখানে না এলে সাঁইজিকে পেতাম না। তিনি খুবই জ্ঞানী এবং রসিক। মেয়েদের এমন কিছু গোপন অঙ্গের নাম তিনি জানেন, স্বয়ং মেয়েরাও জানে না, তাদের এমন কোনও গোপন অঙ্গ সৃষ্ট আছে। বিপুলা এই শরীরের কতটুকু জানি...? ঘুম থেকে উঠলাম সকাল নটায়। ভাল একটা ঘুম হয়েছে। চোখ মেলে দ্যাখি সাঁইজি তামাক টানছেন। আমাকে দ্যাখেই খুব মিষ্টি করে হাসলেন। শাদা পাঞ্জাবী, শাদা লুঙ্গি, শাদা দাড়ি আর শাদা হাসি। কি মধুর আহা! আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, নানা, আপনি যখন উঠেছিলেন, আমাকে ডাকলেন না কেন?
তিনি ধোঁয়া ছেড়ে হাসতে হাসতে বললেন, মনের মানুষকে ডাকতে নেই রে।
কেন নানা?
তিনি উত্তর না দিয়ে গান ধরলেন, মিলন হবে কত দিনে, ও মিলন হবে কতদিনে,
আমার মনের মানুষেরও সনে...
আমি ফোন হাতে নিয়ে দ্যাখি সুপ্তিকার পরপর অনেকগুলো মেসেজ। যেমন- ইমু, রাতে কি খেয়েছিলে? এই ভুলটা কেন করলে? বাসা থেকে না পালালে হতো না? সাঁইজিরা খুব খারাপ মানুষ। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হলে তুমি মরবা। জানি না, আমার ঠিক এই মুহূর্তে তোমার খুব কাছে থাকতে ইচ্ছে করছে। বাসায় কি বলে তোমাকে আনব তাই ভাবছি। আচ্ছা এতগুলো মেসেজ দিলাম, তুমি কিছু বলছো না যে? তুমি কি ঘুমাচ্ছো? মনে হয় তুমি ঘুমাচ্ছো। আচ্ছা তুমি কোথায় ঘুমাচ্ছো?
আমি বিরক্ত হলাম। মেয়ে মানুষের বুদ্ধি থাকলে তারা কখনওই সাঁইজির বিপক্ষে যেতে পারত না। এরা খুবই উদার। গতকাল আমাকে তাদের পাশে রেখেছেন। বিশেষ করে আমি এখন যাকে 'নানা' বলে ডাকছি, তিনি তো তার কাঁথাটাই দিয়ে আমাকে জড়িয়ে দিলেন। কি দয়ার শরীর! এমন ভালবাসা আমি লালন বাবার দরবার ছাড়া আর কোথায় পাব...? এই মুহূর্তে আমি ঠিক করে ফেললাম, বাকি জীবনটা বাবার মুরিদ হয়ে কাটাবো। সকালের প্রথম সিগারেটে আগুন দেয়ামাত্রই সাঁইজি বললেন, চল, সকালের নাস্তা করে আসি।
আমি উঠে পড়লাম। গতরাতে পরিচিত হওয়া দুই বন্ধুর দিকে হাসিমুখে তাকালাম। সাঁইজি একটু সামনে যাওয়া মাত্রই তাদের একজন আমার কানে ফিসফাস করে বলল, খানকির পোলারা ভাইঙা খায়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?
মানে বোঝো না! তারা তোমার, আমার, আমাদের মতন যারাই এখানে আসবে; তাদের টাকায় প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকাল, রাতের খাওয়া সাথে দুই প্যাকেট ডার্বি, আর চা খাবে। পারতপক্ষে কনডমও তোমার টাকাতেই কিনবে। সাঁইজির মারে***! শালা সারাদিন খাই খাই করে। তোর মুখে আমি মুতে দিই।
* ৭ম পর্ব
আমি হতাশ মুখে সাধুবাবার পেছন পেছন আসছি। সঙ্গী দুজন অচেনা বন্ধু, একজন শান্ত, আরেকজন তাপস। দুজনেই খুব ভাল।
আমি এত কষ্ট করে টিউশনির টাকা জমিয়ে লালন বাবার দরবারে এসে যদি তাঁর খাদ্যলোভী মুরিদদের পেছনে খরচ করতে হয়, তবে আমারও এই মুহূর্তে লালন হয়ে যাওয়া উচিত।
বাবার সাথে খেতে বসা হয়েছে। তিনি মাংস বা মাছ খান না বলে আমাদের তিনজনের ঠোঁটে বিস্তৃত হাসি ফোটানোর জন্য মনেমনে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছি। বাবা বেশী খেতে পারেন না। দুটা পরোটা আর ভাজি। সাথে সামান্য খিচুড়ি। তবে খিচুড়ি খেলে মাংস-তে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। খাওয়া শেষে একটা রঙ চা আর দুটা সিগারেট। দুপুরবেলা, রাতেও ভাত। সাথে এমনই সামান্য খাওয়া। বিকেলে সিঙারা, সমুসার বদলে রোল বা পেটিস বা বার্গার দিলে তিনি খুশি হন। আর হাসিমুখে শুনিয়ে দেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি...
মুরিদ বাবাকে আমরা নানা ডাকি। কিন্তু আমি তাকে বাবা বলেই ভীষণ স্বস্তি পাই। অডিটোরিয়ামই এখন আমাদের বাসস্থান। মোবাইল চার্জ দেয়ার সময়েও পাশে বসে থাকা লাগে। বাথরুম চাপলেও চলে যাওয়া যায় না। মোবাইল সরিয়ে বাথরুমে গিয়ে দুই মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেও দ্যাখা যাবে, অইখানে আরেকটা মোবাইল চার্জ দেয়া হয়ে গেছে। বাবা এক্ষেত্রে আমাদের ভীষণ হেল্প করেন। তার দায়িত্বে রেখে গেলে কোনও জিনিশ চুরি হবার ভয় নেই। বিকেলে সামান্য হাঁটাহাঁটি শেষে রাত হলেই অডিটোরিয়ামে গানের আসর বসে। আমরা হয়ে যাই মুগ্ধ শ্রোতা। গান শেষ হলে বাবা আমাদের সাথে নারীর শরীর সংক্রান্ত জটিল কিন্তু সরস মজা করেন। কি যে ভাল লাগে তখন! তার প্রায় সবকথাই 'চ' বর্গীয়। আগে এই মাজারে গাঁজার আসর বসতো। এখন জেলা প্রশাসক তা বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে মেলার সময় ঠিকই বসে। তখন প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ চলে আসেন এই মেলাতে। বিদেশ থেকেও লালন ভক্ত ছুটে আসেন।
একটু আগে বাইরে থেকে চা খেয়ে আসা হয়েছে। এখন সিগারেট খাওয়া চলছে। আমি তৃতীয় সিগারেট ধরানোমাত্রই একজন মহিলা এসে বাবার কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিল। মহিলার বয়স হলেও চেহারায় এখনও রূপ ভাসে। এই ধরনের মহিলাদের দ্যাখলেই কেমন যেন মায়া হয়, আপন আপন লাগে।মনের ভেতর থেকেই আপনাআপনিই "মা" ডাকটা ভেসে আসে। এমনভাবে ডাকতে ইচ্ছে হয়, যেন আমি মা হারা সন্তান। মহিলা সিগারেটে প্রথম ধোঁয়া ছেড়ে চলে যাবার আগে আমি খুবই বিনীতভাবে ডাকলাম, মা!
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ভুবনমোহিনী হাসি দিলেন। এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন। আমি যখন তার আদর খাচ্ছি, ঠিক এই অসময়ে সুপ্তিকা ফোন দিল। আমার সাথে সাথে এই নূতন মা-টাও ফোনকলে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। আমি ফোন কেটে দিলাম। সুপ্তিকা বারবার একই কথা বলে, ইমু, বাসায় চলে যাও প্লিজ। বাবার সাথে ঝগড়া মিটিয়ে ফেল। কিন্তু আমার মনে হয়, লালনের এই দরবারটাই তো আমার বাসা। এই যে পাশে বসে থাকা সাঁইজি বিড়ি টানছেন, তিনিই তো আমার বাবা, আর আমার মাথায় পরম আদরে হাত বোলানো মহিলাটা আমার মা। এতসব ভালবাসা ফেলে আমি কোথায় যাব? কে রাখবে আমায়? বাসায় থাকলে সব থাকবে, বিছানা-বালিশ, সোফা, চেয়ার, টেবিল; সব থাকবে। কিন্তু এই ভালবাসাটা কি থাকবে...? মেয়ে মানুষের বুদ্ধি দিনদিন শূন্যের কোটায় নেমে আসছে। আশংকাজনক ভাবে এভাবে আমাদের অর্ধ জনসংখ্যা মেধাশূন্য হয়ে গেলে আমরা কি কি বিপদে পতিত হব, তা নিয়ে আমি নাতিদীর্ঘ এক থিসিস লিখে ফেললাম। লেখার মাধ্যম চক এবং দেয়াল। মুরিদ বাবা গতরাতে একটা খাঁটি কথা বলেছেন, অসুস্থ হলে যেমন পাইপ নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে খাবার দেয়া হয়, তেমনি নারীর মস্তিষ্কের ভেতরেও পাইপ ঢোকানো এই অসময়ে আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি যাকে মা বলে ডেকেছিলাম, তিনি মাথায় হাত বোলানোর পর বেশ কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমিও প্রতিত্তরে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম। একটা মহিলা এত সুন্দর করে হাসতে পারে, না দ্যাখলে একজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। মহিলার সিগারেট খাওয়াও শেষ, কিন্তু তিনি আমার দিকে এখনও হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। পাশ থেকে তাপস ফিসফিস করে বলল, খুব আদর করে আম্মু বলেছো না! দাও, এবার তোমার আম্মুকে ১০ টাকা দিয়ে দাও।
আমি বিধ্বস্তমুখে তাপসের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি বললে ভাই?
তোমার আম্মু এতক্ষণ ধরে আদর করল, বেচারি কি মাগনা করেছে? দাও তাড়াতাড়ি! আর সবাইকে ধরে ধরে আম্মু, আব্বু ডাকবে না।
আমি মুখে ফ্যাকাসে হাসি এনে মহিলাকে বিশ টাকা দিয়ে দিলাম। পকেটে টাকা ভাংতি না থাকায় ভালো বিপদে পড়া গেল। মহিলা খুশি হয়ে আরও কিছুক্ষণ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে শব্দ করে একটা চুমু খেল। ওপাশের একজন বুড়া মানুষ মাত্রই ঘুমাচ্ছিলেন। তিনিও এই চুমুর শব্দে জেগে উঠে কয়েকবার খুকখুক করে কেশে নিলেন। মহিলা এবার দ্বিতীয় চুমু খেয়ে খুবই নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে মিষ্টি করে বলল, বাবা, মা বলে তুমি আমার চোখে জল এনে দিয়েছো। কেন জানি আমার এখন খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে একটা সিগারেট দিবে?
মহিলা চলে যাওয়ার পর দ্যাখলাম, সুপ্তিকা অনেকগুলো ফোন দিয়েছে। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই, থাকে না কখনওই। আমি আবার বাবার কথায় মনোযোগী হলাম। বাবা হিহি করে হাসতে হাসতে বললেন, বল তো তোরা, সময় গেলে সাধন হবে না!
দিন থাকিতে দিনের সাধন কেন করলে না?
সময় গেলে সাধন হবে না... -বলতে সাঁইজি কি বুঝিয়েছেন?
তাপস কিছুক্ষণ বিচক্ষণের মতন ভেবে বলল, সময় নষ্ট না করা। দিনের কাজ দিনেই শেষ করা। এই তো!
বাবা খুব মধুর করে হাসলেন। হেসে হেসে বেশ মজা পাচ্ছেন, এমন ভঙ্গীতে বললেন, না রে বোকা! সাঁইজি বুঝিয়েছিলেন অন্য ব্যাপার। এটা আসলে নারীকুল নিয়েই লেখা। নারীরা যৌবনে খুবই রূপবতী থাকে। বয়স বেড়ে গেলে কি থাকে রে বেটা?
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, না না, একেবারে না।
বাবা বিড়িতে টান দিয়ে দুষ্টভাবে চিরযৌবনা হাসি মুখে এনে বললেন, মেয়েরা যাতে বয়স থাকতে চো* (সেক্স) করে, তাই বোঝানো হয়েছে রে পাগলা! বয়স বেড়ে গেলে যতই করো, লাভ নাই। মজা নাই, তৃপ্তিও নাই। করতে হবে কম বয়সে, কচি বয়সে। নইলে সাধন হবে না রে পাগলা।
আমার খুব ভালো লাগল। বুড়ো একজন মানুষ যদি এত মজা করে কথা বলতে পারেন, তখন অবাক হলেও বিশ্বাস করতেই হয়, বন্ধুত্ব বয়স দিয়ে বিচার করা বোকামি। গতরাতেও বাবা বলেছেন, কচি মেয়ের কালেকশন আছে, লাগবে নিকি (নাকি) ? বাকি বন্ধু দুটা না বলায় আমিও রাজি হই নি।
সুপ্তিকা আমাকে ফোন দিল। আমি প্রচণ্ড বিরক্তি চেপে হাসিমুখে বললাম, কি খবর?
খুব খারাপ খবর। কোথায় তুমি?
বাবার পদধূলির নিচে।
তুমি এখনও বের হও নি ওখান থেকে? এখনও বাসায় যাও নি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি তো বাসাতেই আছি। এখানে সাঁইজিরা আছেন, মায়েরা আছেন। রাতে কান্না পেলে গুরুর কবরের পাশে গিয়ে বসি। মন ভালো হয়ে যায়। আমি এখান ছেড়ে কোথায় যাব?
সুপ্তিকা বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা বলল না। আমার সাথে আর কোনও কথা বলা উচিত কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। মোবাইলে টাকা উড়ে উড়ে আসে না। এর অপব্যবহার করার চাইতে ব্যবহার করা ভালো। বেশ অনেকক্ষণ পর সুপ্তিকা বলল, ইমু।
জি?
তোমাকে আমি আমার বাসায় নিয়ে আসব। বাবার সাথে থাকতে তোমার আপত্তি থাকলে আমার সাথে থাকবে। আমিই তোমার ঢাকার বন্ধুদের সাথে তোমার মেস এবং জবের ব্যাপারে কথা বলব। আমি এক ঘণ্টার মধ্যেই মাজারের সামনে আসছি, ভেতরে ঢুকব না ভুলেও। ফোন দিলেই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসবে।
আমি খুব করে হেসে বললাম, কক্ষনো না! দরকার হয়তো লালনের মাটি কামড়ে বসে থাকব। তবুও এখান থেকে একচুলও নড়ব না। তুমি আমার জন্য এতকিছু ভেবেছো, তারজন্য ভালবাসা অহর্নিশ। আচ্ছা শোনো, তুমি কি ইপিলইপিল গাছের বিচির মালা গলায় দিবে? এখানে মায়েরা এটা গলায় দেন, এখন আমার গলায়েও একটা আছে। তোমার জন্য একটা শাদা শাড়িও কিনব। তারপর শাদা শাড়ি, ইপিলইপিল গাছের বিচির মালা, গায়ের সারা রাজ্যের বালি, কম আহার গ্রহণ, আর সম্মানিত সিগারেট খেলে কিন্তু তুমিও মহিলা সাঁইজি হতে পারবে। হবে? তারপর আমরা সারাদিন একসাথে গাইব, সত্য কাজে কেও নয় রাজি, সবাই শুধু তা না না না না, জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা! সুপ্তিকা, তুমিই কিন্তু একদিন বলেছিলে, আমার সাথে একদিন খুব করে ঘুরতে তোমার ইচ্ছে হয়। চলে আসো না প্লিজ। বেশী কিছু তো লাগছে না, শুধু একটু সাহস করে যেভাবে আছো, ঠিক সেভাবেই চলে আসো। হেলাল হাফিজের ভাষায়, "আকালের এই কালে সাধ হলে পথে ভালোবেসো,
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো যদি,
লাল শাড়িটা তোমার, পরে এসো।" আচ্ছা সুপ্তিকা, তোমার কি লাল শাড়ি আছে?
সুপ্তিকা ফোন রেখে দিল। আমি কিছুটা বিরক্ত এবং অবাক হলাম। হাসিও পেল। তাহলে এতবার ফোন দেবার মানে কি, যদি কথাই না শুনতে চায়? কিছু কিছু মেয়ের জন্মই হয় মানুষকে আজীবন বিনে পয়সায় উপদেশ দেবার জন্য। সুপ্তিকাও এই শ্রেণীর প্রাণী, তাকে মানুষী বলা যায় না।
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, কিরে রাত হলো কত! খাবি না বুঝি কিছু?
বাবার ক্ষিধে পেয়েছে বুঝতে পেরে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম। আমি একটা সিগারেট ঠোঁট লাগিয়েছি মাত্র, ঠিক তখনি বাবা আমার পাশে এসে বললেন, বুঝলি রে, মানুষের গান গেয়ে গেয়ে লালন ফকির মরলেন, কে দিল তার দাম? আজকাল এত অমানুষ চারপাশে! খুব কান্না পায় এসব দ্যাখলে।
আমি ভাবুক গলায় বললাম, দাম দিলাম আপনার একথায়।
দোকানদার-রা বেচাকেনা করবে, কিন্তু সততা না রেখেই? দুধের ভেতর পানি। সত্য কাজে কেও নয় রাজি...
আমি খুবই আহত হলাম। সত্যের পূজারি লালন সাঁইজি মারা গেছেন। কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠা হলো কই! এখানে যারা তাঁর ধ্যানে মুরিদ হয়েছেন, তারা সত্য প্রচার করুক, এই তো চাওয়া আমাদের।
বাবা একটু বিষণ্ন গলায় বললেন, শোন নানাভাই, একটা মুদি দোকানদার। বানচোতটা আমার থেকে আশি টাকা পায়। একটু দিয়ে দে না আমার লক্ষ্মী নানাভাইটা...!
* ৮ম পর্ব
আমি সাধুবাবার মুখের দিকে তাকালাম। এদের নাম কেন সাধু রাখা হয়, জানি না। পবিত্র পাপ -বলেই কি না!
রাতে নানা আরেকটা আবদার করে বসলেন। তার জামাকাপড় নাকি অনেক ময়লা হয়ে গেছে। খুব খুশি হতেন, যদি আমরা তা ধুয়ে দিই। এবার আর প্রশ্রয় দেয়াটা বোকামি হবে। মুখের উপর বলে দিয়েছি, আহা নানা, বলেন কি? বাসায় তিনটা কাজের মানুষ। নিজের কাপড়টাও তো কখনও ধুই নি, আপনারটা ধুবো কিরূপে...?
সকালে গানের আসর বসল। আমাকে দিয়ে দুটা গান করানো হয়েছে। গান গাইতে দারুণ লাগছিল। শ্রোতাদর্শক মুগ্ধ। দর্শক সংখ্যা তেরো জন। সবাই আশেপাশেই থাকে। গান শেষ হওয়ার পর সবাই হাততালি দিলেও শুধু বোরকা পরা একটা মেয়ে হাততালি দিচ্ছে না। তার বোধহয় আমার গানগুলি পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ হলে নিশ্চয় দিত। আমি নিজের মতন করে গান গেয়ে যাচ্ছি, মানুষ মরলে পরে বিচার হবে কার?
আমি বুঝলাম না ব্যাপার...
ও মানুষ মরলে পরে বিচার হবে কার?
আমি বুঝলাম না ব্যাপার।
কে বলে মানুষ মরে-রে-রে-রে...
আমি বুঝলাম না ব্যাপার।
এই গানটা খুব আবেগ দিয়ে গাইছি। গাওয়ার সময় চোখ জলে ভিজে আসছিল। গান বোধহয় এমনই হওয়া উচিত। কিছু শিল্পী লিরিক দ্যাখে গান গায়, আর কিছু শিল্পীর বুকের ভেতরে জমা কষ্ট-টাই লিরিক হয়ে বের হয়ে যায়। এই দ্বিতীয় শ্রেণির শিল্পীরাই প্রকৃত শিল্পী।
গান শেষ হলো। আমি আসর ছেড়ে চলে যাচ্ছি, এমন সময়েই বোরকা পরা মেয়েটা আমার হাত খপ করে ধরে ফেলল। আমি হতভম্ব হওয়ার আগেই সে প্রায় আমাকে উড়িয়ে নিয়ে বাসে উঠালো। বাসের পাশের সিটে বসে বোরকা খুলে ফেলল। আমার রেশ তখনও কাটে নি। আমি ধরা গলায় বললাম, সুপ্তিকা, তুমি?
হুম আমি।
আমরা কোথায় যাচ্ছি সুপ্তিকা?
আমার বাসায়।
না সুপ্তিকা, আমি লালন ছেড়ে কোথাও যাব না।
প্রচণ্ড জোরে একটা আওয়াজ হলো। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারি নি। যখন বুঝলাম, তখন দ্যাখলাম, আমি থাপ্পড় খেয়েছি।
সুপ্তিকা আমাকে নিয়ে তাদের বাসায় এল। বাসার দরজা খুলে দিল কাজের মেয়ে কহিনুর। কহিনুরের বয়স কম, চব্বিশ হবে হয়তো-বা। আমাকে দ্যাখে সে জিন দ্যাখার মতন চমকে উঠল। আমার পোশাক সাধারণই। গলায় ইপিলইপিল গাছের বিচির মালা, কমলারঙের পাঞ্জাবি, শাদা পায়জামা আর রাবারের স্যান্ডেল। মাথায় ময়লাটে পাগড়ি। কহিনুর দরজা খুলেই দৌঁড় দিয়ে ভেতরে গেল। আম্মা আম্মা বলে চেঁচিয়ে উঠল। আম্মা তার সামনে আসামাত্রই সে আমরা যেন না শুনি তেমনকরে ফিসফিসিয়ে বলল, আম্মা আম্মা, মিষ্টি আপা একটা ডাকাইত ধইরা আনছে। বাসায় ডাকাইত পড়ছে আম্মা। তাড়াতাড়ি ভাগেন! আমার মনে হয়, ডাকাইতটা আপারে ধইরা এখন টাকা চাইব। আম্মা কিছু করেন আম্মা।
কহিনুরের চোখে জল চলে এল। সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। আন্টি পরিস্থিতি সামলে নিয়ে চোখমুখ থেকে ভয়েরচিহ্ন দূরে সরিয়ে ডাকাত দ্যাখতে রুমে এলেন। সুপ্তিকা হাসিমুখে বলল, আম্মু, ওর নাম ইমরান হোসাইন ইমু। আমার বন্ধু। ঢাকায় থাকে। লেখালেখি করে টুকটাক। ওখান থেকেই পরিচয়।
আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে দু'হাত জড়ো করে তা মাথায় লাগিয়ে বললাম, জয় হোক আন্টির।
আন্টি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চূড়ান্ত হতভম্ব এবং বিরক্ত হলেন। বাসায় ডাকাত না পড়লেও পাগল যে এসে পড়েছে, তা নিসন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আন্টির বোধহয় আমাকে বসতে বলার রুচি হচ্ছে না। মনেমনে যে এখনই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছেন, তা আমি বিলক্ষণ জানি। তবুও আমরা মুখের কথার প্রত্যাশী। তাছাড়া গুরু লালন তো বলেছেনই, সারাবিশ্বই তোর ঘর রে পাগলা!
সু্প্তিকা আমাকে বসতে বলল। আমি ঠুস করে বসে পড়লাম না। ব্যাগ থেকে একটা খয়েরী রঙের মাদুর বের করে তা সোফার উপর বিছিয়ে দিলাম। তার উপর সামান্য পরিমাণে রঙিন মোমের গুড়া ছিটিয়ে তার উপর বসলাম। আন্টি ভয় ভয় চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। চা-নাস্তার ব্যবস্থা না করেই তিনি উঠে ভেতরের রুমে চলে গেলেন।
দুপুরবেলায় আমার জন্য পাটশাক, তেলাপিয়া ভাজি আর ডাল করা হয়েছে। নিশ্চয়ই সুপ্তিকারা আরও ভালো খাবার দিয়ে লাঞ্চ করে, কিন্তু আমার মতন ছেলের জন্য সেসব খাবারের অপচয়রোধ করতেই বোধহয় এই আয়োজন। আমার তাতে সমস্যা হচ্ছে না। লালন বাবার দরবারে শুকনো খিচুড়ি গলায় আঁটকে গিয়েছিল। পানি পানে তা নেমেছিল বলেই রক্ষে! আমি ডাস্টবিনের খাবারও খেতে পারি। সমস্যা হয় না তো! সুপ্তিকা আমার পাশে বসে আছে ওপাশে আন্টি, আংকেল আর ছোট দুটা ছেলে। পিঠাপিঠি একেবারে। বয়স হবে ৮/৯ বছর। আমার দিকে তারা চোখ বড়বড় করে তাকাচ্ছে। আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে হাসছি আর খাচ্ছি। আংকেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ঢাকায় থাকো?
জি।
কি করো?
আমি শব্দ শ্রমিক।
আংকেল চট করে খাওয়া বন্ধ করে ফেললেন। আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, তারমানে?
জি, আমি লেখালেখি করি। শব্দের সাথে শব্দ মিলাই।
খুবই ভালো কথা। তা কুষ্টিয়াতে কেন?
বাবার দরবার দ্যাখতে এসেছি।
দ্যাখা হয়ে গেছে?
জি না। বাবার দরবার কি একবার দ্যাখলে সাধে? সারাজীবন এখানেই থাকার প্ল্যান আছে।
শুনে খুশি হলাম।
সুপ্তিকা কোনও কথা বলছে না। আমার সাধু বেশ-টার কারণে অনেকে অনেক কথা বলছে। অথচ আমি তাদের খাই না পরি? মানুষের কৌতুহলের সীমা নেই। সেদিন একটা রিকশাচালককে রাস্তার মোড়ে কি অমানুষিক মারটা না দিলেন এক ভদ্রলোক। সবাই সেখানে জড়ো হয়েছে। একজন মোবাইল হাতে ভিডিও করছে, একজন দু'হাত বুকের উপরে জড়ো করে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, কেওবা চেয়ার টেনে এনে বসে সিগারেট টানতে টানতে দ্যাখছে। কারও হাতে বিকেলের চায়ের কাপ।
আংকেল আবার বললেন, তোমাদের আখড়াতে তো অনেক দেহ ব্যবসায়ী মেয়ে পাওয়া যায়। রাইট?
আমি পতিতার দালালি করি এমন ভঙ্গিতে হেসে বললাম, একদম রাইট। আপনার কয়টা লাগবে? বয়স সীমা ১৬-২৩ এর মেয়েদের আলাদা ডিমান্ড। কচি মেয়েও আছে। প্রথমবার আপনার সাথে করবে, এমন মেয়েও আমি এনে দিব। চিন্তা করবেন না। ফার্স্ট টাইম-ওয়ালা মেয়েরা পরিচিতি ছাড়া আসে না। আমার তো পরিচিতি আছে। আমার মাধ্যমেই আপনি পেয়ে যাবেন। দ্যাখেন অবস্থা, লিংক ছাড়া চাকরিও পাওয়া যায় না, কচি মেয়েও পাওয়া যায় না।
আংকেলের সাথে-সাথে আন্টিও এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এমন বেয়াদবকে সুপ্তিকা কেন বাসায় এনেছে, তার জন্য সুপ্তিকার ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। সুপ্তিকা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মাথানিচু করে বলল, চুপ করে খাও।
আমি চুপ করেই খাচ্ছি। কেও প্রশ্ন করলে জবাব দিই, এই তো!
খাওয়া শেষ হয়েছে। কহিনুর ফ্যাকাসে মুখে প্লেট নিতে এসেছে। আমার দিকে সরাসরি তাকাতে তার রুচি হচ্ছে না, বোধহয় ভয় হচ্ছে। আমি খাওয়া শেষ করে শূন্য প্লেটে পানি ঢেলে তাতে এক চিমটে লবণ আর লেবুর রস মিশিয়ে পানিটা খেয়ে দু'হাত জড়ো করে তা মাথায় লাগিয়ে বললাম, আমাকে এত ভালোভাবে খাওয়ানোর জন্য আপনাদের অনেক কৃপা। কৃপাময় আংকেল এবং আন্টির জন্য ভালবাসা অবিরাম।
কহিনুর বিধ্বস্ত চোখে আমার প্লেট-টার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বোধহয় এই প্লেটটা স্পর্শ করতেও ভয় পাচ্ছে।
বিকেল বেলায় পিচ্চি ছেলে দুটাকে আমাকে দেয়া রুমটা-তে নিয়ে গেলাম। আমি গান ধরেছি। তারা সুর মিলিয়ে গাইছে। তারা বোধহয় অনেকদিন পর আজ একটু আনন্দ করতে পারছে। দ্যাখে নিজেরই ভীষণ ভাল লাগা কাজ করল। আংকেল ভেতরের রুমে সবেমাত্র পত্রিকা নিয়ে বসেছিলেন। আমার বেসুরা গলায় গানের বিকট শব্দে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তিনি দাঁতমুখ কুঁচকে হড়বড় করে আমার রুমের দিকে এগিয়ে আসছেন। পত্রিকা-টা যে পড়তে দেয় না, তার সাথে নয় লেনাদেনা। আজই, খুব সম্ভব এখনই আমাকে হয় মেরে ফেলা হবে, নয়তো হাত-পা, সাথে মুখটা বেঁধে তারপর তিনি পত্রিকায় পড়ায় মন দিবেন। আমি আমার রুমে মুগ্ধ শ্রোতা দুই বালককে নিয়ে মনের আমেজে গেয়েই চলেছি, মরার দেশে ভাল লাগে না
ও মরি, উপায় কি যে বল না
মরার দেশে ভাল লাগে না।
মরায় মরায় যুক্তি করে
জিন্দা ধরে খায়,
মরায় করে রাজ্যশাসন
মরায় দেশ চালায়...
* ৯ম পর্ব
ভদ্রলোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে আমার দিকে তেড়ে আসছেন। তাকে অতিসত্বর নিবারণ করার প্রয়োজন দ্যাখে সুপ্তিকা আর আন্টি ধরাধরি করে বসালেন। ভদ্রলোক শান্ত হচ্ছেন না। আমাকে কেন বাসায় আনা হলো, তা নিয়ে সুপ্তিকার সাথে রীতিমত ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেললেন। বাউল টাইপ প্রাণীদের যে ঘরে রাখতে নেই, তা নিয়ে রীতিমত নাতিদীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। সুপ্তিকা শান্ত মাথায় সব শুনেই যাচ্ছে, কোনও প্রতিবাদ করছে না। সুপ্তিকার সাথে তার বাবার যেসব কথা হলো-
আংকেল উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলছেন, ভদ্রলোক বাসায় সুন্দর,
বাউলরা পথেঘাটে।
সুপ্তিকা মাথা নেড়ে বলল, রাইট।
রাইট বললে হারামজাদা-টাকে এক্ষুণি বের করা কি উচিত নয়?
রাতটা থাকুক। ছেলে বিপদে পড়েছে।
বিপদে পড়েছে! হোয়াট ননসেন্স! এটা কি আশ্রম?
না বাবা। বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়াব না?
কাদের সাথে মিশো তুমি আজকাল? বাউল তোমার বন্ধু?
সুপ্তিকা মাথা ঠাণ্ডা করে বলল, আচ্ছা বাবা, কালকেই বিদায় করব। আজ থাক না!
আংকেল কিছুটা ধাতস্থ হলেন। রুমে ফিরে গিয়ে আবার পত্রিকা পড়ায় মন দিলেন। আমার রুমে সংগীতের আসর বসেছে। পিচ্চি দুটা ছেলে আমার নূতন সাকরেদ। আমি আবার গান ধরেছি, তুমি কোন-বা দেশে
থাকো রে দয়াল চাঁন...
আংকেল ভ্রু যুগল আবার কুঞ্চিত হলো। এভাবে পত্রিকা পড়া যায় না। নিজের বাসায় মন দিয়ে পত্রিকা পড়তে না পারেন যদি বাইরের মানুষের অত্যাচারে, তবে সেটা অসহনীয় শক্তির পর্যায়ে চলে যায়। এবার আমার সাথে-সাথে পিচ্চি দুটাও বেসুরা গলায় গান ধরেছে। আংকেল বেশ নির্বিকার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। সুপ্তিকাকে আড়াল করে তিনি আমার রুমে প্রবেশ করলেন। বেশ শান্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি লেখালেখির পাশাপাশি গানও গাও নাকি?
আমি মিষ্টি করে হেসে বললাম, জি। অভ্যাস করছি।
খুব ভাল কথা! তা গান নিশ্চয়ই অন্য মানুষের বাসায় বসে বাসার সবাইকে বিরক্ত করে রেওয়াজ করার যৌক্তিকতা নেই। তুমি কি বুঝতে পেরেছো, আমি কি বলছি?
জি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সারাবিশ্বকেই তো আমি নিজের বাসা মনে করি।
তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন কি বললে তুমি?
সারাবিশ্বকেই তো আমি নিজের বাসা মনে করি।
তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছো, এটাও তোমার নিজের বাসা? এবং এখানে বসে রেওয়াজ করাটা কোনও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না?
জি না।
তুমি কিছু মনে করো না, তুমি কাল সকালেই চলে যাবে?
আমি কিছু বলে উঠার আগেই পিচ্চি দুটা হুংকার ছেড়ে বলে উঠল, না, ইমু ভাই কোথাও যাবে না, ইমু ভাই যেখানে যাবে, আমরাও সেখানে যাব।
আংকেল সরুচোখে রাজ্যের রাগ নিয়ে বললেন, কি বললে তোমরা?
আমরা ইমু ভাইয়ের সাথে যাব। ইমু ভাই ছাড়া আমাদের কে গান শিখাবে?
আংকেল কিছু বললেন না। চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন।
পরদিন সকালে আমি সুপ্তিকার বাসা ছাড়লাম। সুপ্তিকা লজ্জাশীল নারী বিধায় তার চোখমুখ রাঙা হয়ে উঠছে। অথচ লজ্জিতা হবার মতন তার কিছুই ঘটে নি। আমার ভাড়া আছে কিনা, খাওয়ার পয়সা আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারটা প্রশ্ন শেষে হাতে একহাজার টাকার নোট তুলে দিয়ে বিদায় হলো। বিদায়বেলায় তার চোখ ছলছল করে উঠল। আমি তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললাম, বাসায় যাও সুপ্তিকা।
আমি সেদিন আর ঢাকায় ফিরে আসি নি। পকেটে কানাকড়িও নেই, সুপ্তিকার টাকা খরচ করব কিনা ভাবছি, পেটে লেগে আছে রাজ্যের ক্ষিধে। রেস্টুরেন্টগুলো আমার দিকে নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। মানুষ আসলে প্রয়োজন বিলাসী। প্রয়োজন ছাড়া পৃথিবীর রূপ তার চোখে ধরা দেয় না। যার বাথরুম চেপেছে ভয়ানক-ভাবে, সে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দ্যাখার চাইতে পাবলিক টয়লেট দ্যাখলেই খুশি হয়ে যাবে। যার পেটে ক্ষুধা উপস্থিত, তার কাছে তাজমহলের চাইতে রেস্টুরেন্ট বেশী আকর্ষণীয়। মূলত, তখন তার চোখ শুধু রেস্টুরেন্ট খোঁজে বলেই পৃথিবীর অনেক রূপ তার চোখে ধরা দেয় না। মানুষ অন্ধ ষাঁড়ের মতন প্রয়োজনের দিকেই পা বাড়ায়। প্রয়োজনই মানবের সৌন্দর্যকে হরণ করেছে।
সাবিলার বাসায় দাওয়াত পড়েছে। গতরাতে সাবিলার বাবা আমায় ফোন করে বলেছেন, শোনো ইমু, তোমাকে কাল বাসায় দাওয়াত দেয়া হয়েছে। সাবিলার মা তোমাকে দাওয়াত দিয়েছে, আমি নই। কিন্তু বাসার হাউজওয়াইফ-রা টাকা ইনকাম করে না। তোমার জন্য আমার পকেট থেকে সে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে। এটা বাড়াবাড়ি আতিথ্য। কোনও ভালো ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টেও তোমাকে খাওয়ালে এত খরচ আসতো না। যাই হোক, তুমি দয়াকরে তাকে বলে দিবে, কাল তুমি আসছো না। তোমার টিউশনি আছে।
আমি সহজ করে বললাম, কাল তো শনিবার। আমার কোনও টিউশনি নেই।
ভদ্রলোক কড়া গলায় বললেন, মিথ্যে করে বলবে, আছে। মিথ্যে বলতে পারো তো?
জি না।
সাবাশ! এই তো সূচনা করলে। কাল তুমি আসবে না। আমি চাই না, এত দামী খাওয়াগুলো তোমার মতন লেখকের পেছনে খরচ হোক।
লেখকরা কি মানুষ নয়?
অবশ্যই। তবে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের সাথে আমাদের কোনও আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকছে না। লেখকদেরকে আত্মীয় করা, আর চিতার আগুনে ঝাঁপ দেয়া একই কথা! কাল তুমি আসবে না, ব্যস! আমি তোমার মুখও দ্যাখতে চাই না।
আমি কিছুক্ষণ সময় নিলাম। মহিন সাহেব গভীর জলের মাছ, আন্টিও গভীর জলের মাছ। একমাত্র সাবিলাই পানির উপর লাফালাফি করে। আমি মিহি সুরে বললাম, আংকেল।
বল। ডিসিশন মেনে নিলে তাহলে?
জি না। বেশ কিছুদিন আগে সাবিলার নানুরা আপনাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। রাইট?
রাইট। তো?
তারপর বেশ কিছুদিন থেকে বাড়ি ফেরার সময় সাবিলার নানুর লাল রঙের ব্লাউজটা আর পাওয়া যায় নি। ঘটনা কি?
ওপাশে পিনপতন নিরবতা। কেও কোনও কথা বলছে না। সাবিলার সাথে আমার কথা বলার সময় আমরা দুজনেই চুপ থেকে এই নিরবতা উপভোগ করি। নিঃশব্দেরও যে একটা ভাষা আছে, তা প্রেমিক প্রেমিকা ছাড়া ভালো কেই-বা জানে...? সাবিলার সাথে মুহূর্তটা উপভোগ করলেও সাবিলার বাবার সাথে মুহূর্তটা ক্লান্তিকর হয়ে যাচ্ছে। তারই প্রথম কোনও কথা বলে নিরবতা-টা ভঙ্গ করা উচিত। তিনি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চেপে চেপে শীতল গলায় বললেন, তুমি কি পাবদামাছ পছন্দ করো?
জি।
আংকেল হাসিমুখে বললেন, কাল তোমার জন্য পাবদামাছ রান্না করা হবে, বাবা। দারুণ চয়েজ তোমার! অনেকদিন তোমার সাথে বসে গল্প করি না। কাল অবশ্যই আসবে, একসাথে গল্প হবে। একজন লেখক মাথায় হাজার হাজার বই নিয়ে ঘোরে। তাদের সাথে কথা বলাও ভাগ্যের ব্যাপার।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কৃতজ্ঞতা। ফোন রাখছি।
সে কি বলছো! রাগ করেছো নাকি বাবা?
জি না। কাজ করছি। বাজে সময় নষ্ট না করি।
আচ্ছা বাবা, সমস্যা নেই। তবে ইয়ে... মানে... সাবিলার মা তো একটু দাজ্জাল টাইপের, জানোই তো! সাবিলাও তেমন। বিয়ের পর বুঝবা, বৌ সামলানো যুদ্ধ জয়ের চাইতেও কষ্টকর। ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং সেনাপ্রধান নেপোলিয়ন অনেক দেশ জয় করেছেন। কিন্তু কষ্টের ব্যাপার হলো, তাঁর স্ত্রী নেপোলিয়নের এক জুনিয়র অফিসারের সাথে ভেগে গেছিল। বোঝো অবস্থা! এমন বিশ্বজয়ী নায়কও বৌ সামলাতে পারে নয়। আমরা তো সেখানে ছাইপাঁশ।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য ধন্যবাদ। এখন ফোন রাখি। কাজ করব। আমি গম্ভীর।
মহিন সাহেব ইতস্তত করে বললেন, মানে বাবা, কাল কিন্তু আসবা। ওকে?
ওকে।
আর অই... ইয়ে... মানে শাশুড়ির ব্লাউজের ব্যাপারটা তোমার আর আমার মধ্যেই থাকল তাহলে। বাসায় আর ঝামেলা না করি। আমি আর তুমি তো বন্ধুর মতন। দুজনেই নারীর কাছে অসহায়। কি বলে বাবা? গোপন থাকল। ঠিক আছে...?
* ১০ম পর্ব
আমি চুপ করে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছি। প্রেমিকার বাবা শ্রেণীর মানুষের সাথে বেশী কথা বলা মানে, খাল কেটে তিমি আনা। ওপাশ থেকে ভদ্রলোক ব্যস্ততার সাথে বললেন, কি বাবা, বল কিছু।
আমি চুপ।
বল কিছু।
আমি নিরুত্তর।
বল না কিছু।
আমি নৈশব্দের সাথে সতীন।
ভদ্রলোক বোধহয় মনেমনে ফুঁসছেন। ফুঁসতে ফুঁসতেই রাজ্যের রাগ নিয়ে দাঁত-মুখ কুঁচকে বললেন, অবশ্য তুমি তো একটা চামার বাউল! বাউল শব্দের অর্থ জানো? সংস্কৃত 'বাতুল' শব্দ থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি। দার্শনিক ড. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বাউলকে 'আউল' শব্দজ বলে মনে করতেন। আউল আরবি 'আউলিয়া' সম্ভূত। কিন্তু আসলেই বাউল শব্দের শানে নজুল কি তুমি জানো...? বাতুল শব্দের অর্থ হলো অপদার্থ। আর এই অপদার্থ (বাতুল) থেকেই বাউল শব্দের জন্ম। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে বাউল শব্দের অর্থ দাঁড়ায় উন্মাদ, পাগল, বিশৃঙ্খল। বুঝলে?
তিনি রীতিমতো রাগে ফুঁসছেন। আমারও প্রচণ্ড রাগ সৃষ্টি হতে আরম্ভ করল। বাউলদের পাগল বলা মানে শাহ আবদুল করিম, লালন শাহ, চিশতী বাউলকে পাগল বলা। লালন অবশ্য বলেছেন, সবাই পাগল হতে পারে না। পাগল হওয়াও একটা কোয়ালিটির ব্যাপার। তবুও অন্ধকে বারবার অন্ধ বললে তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগবেই। আমারও লাগছে। আমি কণ্ঠস্বর খুবই শীতল করে বললাম, ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে 'ব্লাউজ' শব্দের শানে নজুল-টা এবার একটু বয়ান করি...?
ওপাশে আবার পিনপতন নিরবতা। তবে আগের মতন এই নিরবতা দীর্ঘস্থায়ী হল না। আংকেল হড়বড় করে বলে ফেললেন, না না, থাক বাবা। তবে সুফি দর্শন মতে, বাউল দর্শনের মূলকথাই হলো, প্রেম। যাদের দর্শনের মূলকথা প্রেম, তারা অবশ্যই চিরন্তন ভালো মানুষ। বাবা, কাল কিন্তু দেরী করবে না। ঠিক দুপুরবেলায়েই চলে আসবে, কেমন?
আমি ফোন রেখে দিলাম। পাশের বাসা থেকে বেশ কিছুরাত ধরে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। চিৎকারটা জহির সাহেবের বালিকা স্ত্রীর। জহির সাহেব সদ্য বিয়ে করেছেন। তাদের বাসা থেকে এমন চিৎকার আসাটা মোটেই অনুচিত নয়। এটা বৈধ চিৎকার। তবে প্রতিরাতে আসাটা কেমন যেন রহস্যজনক। তাছাড়া জহিরের সাহেবের বয়সও হয়েছে। প্রতিরাতে করার মতন শক্তি তার শরীরে উপস্থিত থাকার যৌক্তিকতা নেই। এই পর্যন্ত এসে আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুল করছি। সবার মতন চিন্তা করে ফেলছি। অথচ ব্যতিক্রম চিন্তা না করলে কখনও বিশুদ্ধ বাউল হওয়া যায় না। লালন শাহের একটা গান আছে, মিলন হবে কতদিনে
ও মিলন হবে কতদিনে,
আমার মনের মানুষেরও সনে
আমার মনের মানুষেরও স-স-স-সনে...
৮০% শ্রোতাই এই গানটাকে প্রেমের গান হিশেবে আখ্যায়িত করেছেন। মানুষ ভেবেছে, মনের মানুষটা অনেক দূরে আছে, তার সাথে বহুদিন ধরে দ্যাখা সাক্ষাৎ নেই। তাই তার প্রতি হাহাকার জানিয়ে এই গান। লালন কিন্তু এটাকে প্রেমের গান মনে করে লিখে যান নি। লালন মূলত দেহবাদী ছিলেন। দেহতত্ত্ব তাঁর গানের অন্যতম একটা প্রধান ভাব। তাঁর মতে, যা আছে ব্রক্ষ্মাণ্ডে (বিশ্বে), তা আছে দেহভাণ্ডে। আর, পরমপুরুষ এই দেহাভ্যন্তরেই বাস করেন। দেহস্থিত আত্মাকে তিনি 'মনের মানুষ' বলে মনে করতেন, এবং বিশ্বাস করতেন, এই আত্মা পরমাত্মারই খণ্ডিত অংশ। আত্মাকে জানলে পরমাত্মাকে জানা হয়। তারমানে, মনের মানুষ আসলে, আমি নিজেই। অচেনা আমিকে খোঁজ করবার জন্যই এই গান। নিজের ভেতরের অজানা শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর নিমিত্তেই গানটি লেখা হয়েছে। গতানুগতিক ধারার প্রেমিকাকে খোঁজা গানের মূল বৈশিষ্ট্য নয়।
আমি বাসা থেকে বের হলাম। জহির সাহেবের বাসায় যাওয়া উচিত। তাদের ছেলে না মেয়ে আসছে, তাও জানা প্রয়োজন। প্রশ্নটা কিভাবে করা যায়, জানি না। বুঝে উঠতেও পারছি না, কি বলে শুরু করব। জহির সাহেব দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দ্যাখে কিছুটা চমকেও উঠলেন। চমকে উঠার মতন কিছুই ঘটে নি। আমি তার পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। চেনা মুখ দ্যাখেও মানুষ বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে চমকে উঠে।
আমি খুব নরম গলায় বললাম, আপনার স্ত্রী কেমন আছে?
জহির সাহেবের চোখমুখ ফ্যাকাসে। তিনি শুকনো গলায় বললেন, ভালো না। খুব অসুস্থ। শরীর দুর্বল। রাতে দুঃস্বপ্ন দ্যাখে চিৎকার করে উঠে। একটা বড় টিকটিকি নাকি বুকের উপর বসে থাকে। অবাক করার মতন বিষয় হচ্ছে, সে যখন স্বপ্নে দ্যাখে যার বুকের উপর টিকটিকি-টা বসে আছে, সেই ব্যক্তি-টাই তিনদিনের মাথায় মারা যায়। এটা বিস্ময়কর! ডাক্তার বলেছেন, ওর মানসিক সমস্যা আছে।
জহির সাহেব দরজা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ভেতরে আসুন।
আমি হতাশ জহির সাহেবের ঘরের ভেতর ঢুকলাম। তার বালিকা স্ত্রীর রুমে তিনিই আমাকে ডেকে নিলেন। আমি গেলাম। মেয়েটা বিছানায় আধ-শোয়া হয়ে আছে। দ্যাখে ভীষণ মায়া লাগছে। বিছানার পাশের টেবিলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা শুকনো আপেল দিয়ে চাপা দেওয়া আছে। ওপাশের একটা বালিশের উপর ভেজা কাপড়ের একটা টুকরো। জ্বরপট্টি -যাকে বলে। আপেল, আঙুর, কমলা, লিচু -ফলের কোনও কমতি রাখেন নি জহির সাহেব। সারারাত না ঘুমানোর কারণে তার চোখ ফোলা ফোলা এবং লাল হয়ে গেছে। স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসেন তিনি। খুব সম্ভব, নূতন বিয়ে করার পর থেকে প্রথম সন্তান আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত একটা ঘরে ভালবাসার কমতি থাকে না। সন্তান আসার পরপরই কি আস্তে আস্তে স্বামীদের ভালবাসা কমে যায়? কয়েকটা পরিবারে অবশ্য কমে যেতে দ্যাখেছি। কেন -তা জানি না। সম্পর্কের প্রথম কয়েকমাস প্রেমিক প্রেমিকা একজন আরেকজনের সাথে প্রচুর কথা বলে, দ্যাখা করে। চোখের আড়াল হতে দেয় না। এটা করার মূল কারণ, হারিয়ে ফেলার ভয়। মেয়েটাকে বা ছেলেটাকে যথার্থ সময় না দিলে যদি তারা অন্যকারও সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তারই মতন করে, তাহলে...? সেখানে যতটা না প্রেম থাকে, তারচে' বেশী থাকে ভয়। কিন্তু একবছর পর দ্যাখা যায় যোগাযোগ আস্তে আস্তে কমে আসে। আগে যেখানে প্রতিদিন কথা বলতে হতো, না বললে ছারখার লাগতো; এখন সেখানে সপ্তাহে একবার কথা বললেই মনে হয়, যথেষ্ট বলা হয়েছে। দ্যাখা করাও কমে আসে। তার কারণ, একটা সময় পর ছেলেটা এবং মেয়েটা বুঝে যায়, তার ভালবাসার মানুষটাকে চোখের আড়াল করলেও সে মনের আড়াল হবে না। সে এই সম্পর্কে বেঁধে গেছে। এখন সে চাইলেও দূরে সরে যেতে পারবে না। এটাকে সম্পর্কের "বয়স সূচী" বলা যেতে পারে। মা যেমন একটা বয়সের পর সন্তানকে বলেন, তোর যেখানে ইচ্ছা সেখানে যা! তেমনি একটা সময়ের পর প্রেমিকারাও এই কথাটা বলতে ভয় পায় না। বিয়ের পর সন্তান হলে কি অনেক স্বামী এটা ভেবে ভালবাসা কমিয়ে দেন যে, তাদের যেহেতু একটা সন্তান হয়েই গেছে, সেহেতু তার স্ত্রী চাইলেও সামাজিক বাঁধার মুখে সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে অনেকবার ভাববেন...?
আমি মেয়েটার মাথায় হাত বোলালাম। মেয়েটা শান্ত মেয়ের মতন বসে আছে। কোনও কথা বলছে না। তার স্বপ্নের জোর এত বেশী যে, সে স্বপ্নে কোনও ব্যক্তির বুকের উপর টিকটিকি বসে থাকতে দ্যাখলে তার মৃত্যু কার্যকর হয়ে যাবে! এটা কি কাকতালীয়, নাকি অলৌকিক, নাকি সায়েন্সরই একটা থিওরি, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমি তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, কেমন আছো?
সে নিরুত্তর।
আচ্ছা আচ্ছা। তুমি আমাকে চেনো?
সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
তোমার আপেল খেতে ভালো লাগে?
সে না সূচক মাথা নাড়ল।
আঙুর?
সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
জহির সাহেব এই সময়ে আমার জন্য চা করতে ভেতরে গেলেন। খুব সম্ভব, স্ত্রীকেই তিনি এখন রান্না করে খাওয়ান। আমি খুব আগ্রহী হয়ে শীতল গলায় বললাম, গতরাতে কারও বুকের উপর টিকটিকি দ্যাখেছো?
সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
কার বুকে?
* ১১তম পর্ব
মেয়েটা মুখ খোলার আগেই জহির সাহেব রুমে চলে এলেন। তার হাতে টোস্ট বিস্কিট, চানাচুর আর চা। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলে শোনার ইচ্ছে চেপেছে, আবার ভয়ও করছে। যদি এমন হয় যে, মানুষটা আমার খুব পরিচিত, তবে...? জহির সাহেব তার স্ত্রীকে বললেন, কিছু খাবে?
সে না সূচক মাথা নাড়ল। তিনি তার স্ত্রীকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমি আমার প্রশ্নের জবাব পেলাম না। এটা একদিক থেকে ভালো হলো, আবার খারাপও হলো। আমাদের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যেসব মুহূর্তে আমরা একইসাথে মনোযোগ দিই, আবার রিলাক্সবোধ করি। একইসাথে জীবনটাকে সত্য মনে হয়, আবার অর্থহীন মিথ্যে মনে হয়। কিছু কিছু প্রশ্নের জবাব না পেলেই বোধহয় ভালো। আমাদের উৎসাহ বাড়ে। যার কারণে মাথায় এমন জিদ চেপে বসে যে, সবকিছু তছনছ করে, জগত সংসার ত্যাগ করে হলেও আমরা সেসব প্রশ্নের মুখোমুখি নিজেদের দাঁড়া করাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। জীবনের অর্থ হচ্ছে সবচে' দামী এবং সবচে' অর্থহীন প্রশ্ন। জর্জ বানাড'শ বলেছেন, Life is not searching yourself, life is just creating yourself. অনেকে আবার নিজেকে হারিয়ে আমিত্ববোধকে জাগিয়ে দিয়ে বেঁচে থাকবার অর্থ খুঁজে পায়। আমার মতে, জীবন হচ্ছে মৃত্যুর প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্বের সামনে কোনও বস্তু রাখলে যেমন তা উল্টো দ্যাখা যাবে, তেমনি মৃত্যু আর জীবন দুটোই পাশাপাশি থাকে, তবে উল্টাে হয়ে। যারা স্বপ্ন থেকে, ভালো লাগা থেকে দূরে সরে যায় ব্যস্ততার অজুহাতে, তারা মূলত উল্টো পথে হাঁটতে গিয়ে কবেই যে না ফেরার দেশে চলে গেছে জীবিত থেকেই, তা তারা নিজেরাই জানে না।
সাবিলাদের বাসায় দাওয়াত খেতে এসেছি। আয়োজন যথেষ্টই ভালো। বিয়ের খাবার বিয়ের খাবার টাইপ একটা ভাব আছে। কোনও প্রেমিককে এমন রাজকীয় অনুষ্ঠান করে কোনও প্রেমিকার মা খাওয়ায় বলে আমার মনে হয় না। আংকেল আমার সাথে খেতে বসতে চান নি। কিন্তু আন্টির পিড়াপিড়ি-তে খেতে বসতে হয়েছে। আন্টির শেষ দিককার কথাগুলো ছিল এমন, কেন? ইমুর সাথে খেতে বসতে কি আপত্তি?
আংকেল ফিসফিস করে রাগ নিয়ে বললেন, লেখক শ্রেণীর প্রাণীদের সাথে কাজের মেয়েটাকেও খেতে বসিয়ে দাও, কিন্তু আমাকে ঘুণাক্ষরেও এমন কথা বলবা না।
আন্টি সবকিছু বুঝে ফেললেন, এমন ভঙ্গিতে বললেন, কেন? ছাদে যাবার খায়েশ জেগেছে বুঝি? শুনি তো আজ কোন ভাবী ছাদের ব্লাউজ শুকাতে দিয়েছে! লেখকদের সাথে খেতে বসি না বলে অজুহাত দ্যাখানো হচ্ছে। হারামজাদা! তোকে চোখের আড়ালই করব না।
আংকেল এখন আমার পাশে। চুপচাপ মুরগীর রান চিবাচ্ছেন। তাকে দ্যাখে ভীষণ মায়া হচ্ছে। এমন একজন সহজ সরল মানুষের কোনও এক মিষ্টি টাইপের মেয়ের সাথে বিয়ে হলে ভালো হতো। তা না হয়ে রীতিমতো মহিলা আজরাইলের সাথে বাস করছেন। এই দুঃখ বেচারার কোনওদিনই যাবে না। আন্টি আমাকে অতি সামান্য পোলাও দিয়েছেন। পুরো প্লেট ভর্তি করে রেখেছেন রোস্ট, চিংড়ী ভাজি, ইলিশ মাছ, ঝোল বেশী দিয়ে পাবদামাছ, ঝাল গরু, মিষ্টি কুমড়ো দিয়ে গরু, ঝাল মুরগী, ডিমের মোরব্বা। আংকেল বোধহয় টাকার অংকটা পাঁচ হাজার বলেছিলেন। আমার মনে হয়, এই আয়োজনে পাঁচ হাজারের চাইতেও আরও বেশী খরচ হয়েছে।
খাওয়া শেষে কি মনে করে আংকেল আন্টির পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। সাবিলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক এই মুহূর্তে তারও কি সালাম করা উচিত কিনা, ভাবছে। বোধহয় উচিত না। কারণ এটা বিবাহের পূর্ব দাওয়াত। এখানে পা ছুঁয়ে সালাম করার কোনও বিধি নেই, মাসালা-মাসায়েল নেই। কাজ হলো, পা ছুঁয়ে সালাম করার জন্য আন্টি আমাকে তিন হাজার টাকা দিয়ে বসলেন। আমার জন্য এটা বাড়াবাড়ি বটে। আমি টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অবাক হওয়াটা গোপন করে শুধু ভদ্রতাসূচক হাসি হাসছি। একটা বস্তির ছেলেকে যেমন লাখ টাকা ধরিয়ে দিলে সে প্রথমে অবাক হবে, তারপর অবিশ্বাস করবে, তারপর ভাববে আজ গাঁজা বেশী খাওয়া হয়ে গেছে, এবং শেষমেশ ভাববে, অলৌকিক ব্যাপারগুলো আমাদের সাথে ঘটে, কারণ আমরা অলৌকিকতায় বিশ্বাসী। আমার এখন তৃতীয় পর্যায় চলছে। অথচ আমি আজ নেশা করে আসি নি। একটুপর নিশ্চয়ই মনে হতে শুরু করবে, জীবন সুন্দর।
সাবিলার বাসা থেকে বের হয়েই একটা সিগারেট ধরালাম। এত ভালো খাওয়ার পর একটা সিগারেট না ধরালে খাওয়ার বিশাল আয়োজন-টাকে অসম্মান করা হয়। সিগারেটে টান দিতে দিতে সুপ্তিকাকে ফোন করলাম। অনেকবার রিঙ হয়ে কেটে গেল, কেও এসে ফোনটা ধরল না। আবার ফোন দিলাম। তিনবার রিঙ হওয়ার পরপরই তার মা ভারী গলায় বললেন, কে বলছো?
আমি বললাম, আন্টি, আমি ইমু। অই যে আপনাদের বাসায় একদিন এসেছিলাম। লালন বাবার একনিষ্ঠ মুরিদ।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, চিনেছি। কেন ফোন দিয়েছো? সামনে রমজান মাস। ফিতরার টাকা তোমাকে বিকাশ করে দিতে হবে। এই তো?
আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা কি বললেন আপনি? আমি এতটাও গরীব নই। আচ্ছা, সুপ্তিকা কৈ?
তিনি কিছুটা বিষণ্ণ গলায় বললেন, ও হাসপাতালে।
কি হয়েছে তার?
তা জানি না। তবে শরীর অত ভালো না। তোমার সাথে অনেকবার কথা বলতে চেয়েছে, আমি দিই নি। আমি দ্যাখেছি, তোমার কথা ওর যতবারই মনে পড়ছে, ততবারই ও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ও সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি চাই না, তুমি আর কখনও তাকে ফোন করো। বুঝেছো?
একটা মহিলা এত শক্ত কথা কিভাবে বলতে পারেন, আমার জানা ছিল না। আমার মন সহজে খারাপ হয় না। আজ এত খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে মনকে কোনওভাবেই ভালো করা যাচ্ছে না। যারা সহজে রাগে না, তারা রাগ করলে কেও তাদের থামাতে পারে না। এটা মানব বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক। আমরা সহজে যেসব কাজে অভ্যস্ত, সেসব কাজের গুরুত্ব আমাদের কাছে নেই। কিন্তু যে কাজগুলো-তে আমরা অনভ্যস্ত, সেসব কাজগুলোই আমাদের কাছে অর্থবহ হয়ে ছায়ার মতন জড়িয়ে থাকে।
আমি বাসায় ফিরে এলাম। জহির সাহেবের বাসা থেকে তার স্ত্রীর চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। জানি না, সে গতরাতে কাকে স্বপ্নে দ্যাখেছে। সুপ্তিকাকে নয় তো? যদি এসব সত্যি হয়ে থাকে, তবে জহির সাহেবের স্ত্রীকে মেরে ফেলাই উচিত। এতগুলো মৃত্যু থেকে অন্তত একটা মৃত্যু লজিক্যাল।
* ১২তম পর্ব
আমি ফোন হাতে নাড়াচাড়া করছি। কাকে ফোন দেয়া যায় ভাবছি। জহির সাহেবকে ফোন দিলে কেমন হয়? তিনি যদিও আমার পাশের বাসায়েই থাকেন, ইচ্ছে হলে গিয়েই একটু কথা বলে আসা যাবে। ইচ্ছে না করায় তাকে ফোন দিলাম। তিনবার রিঙ হতেই তিনি ফোন ধরলেন। হাসিমুখে বললাম, ভাই, কেমন আছেন?
তিনি ধরা গলায় বললেন, জানি না।
আপনার স্ত্রী?
ভালো না।
গতরাতে কাকে স্বপ্নে দ্যাখেছে?
অপরিচিত কোনও মেয়েকে।
বর্ণনা দিবেন ভাই?
তিনি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন, আপনার সাথে নাকি তার পরিচয় আছে।
আমি ইতস্তত করে বললাম, মেয়ে কি কুষ্টিয়া থাকে?
জি।
কপালে একটু পরপর আঙুল ঘষে?
জি।
সিরিয়াস ক্যাটাগরির মেয়ে?
জি।
নামটা কি তার?
জানি না।
আমি বাসা থেকে বের হলাম। সামনের চা দোকানটাতে চা সিগারেট খাওয়া যায়। বাকিতে খেলেও দোকানদার কিছু বলে না। বেশ ভালো মানুষ। আমার একবার দুইশ বাইশ টাকা বাকি পড়েছিল। পকেটে সিগারেটের টাকা নেই, কিন্তু অন্তরে সিগারেটেরর নেশা নিয়ে দোকানের সামনে ঘুরঘুর করছি, এমন সময় তিনি ডেকে বললেন, ভাই বসেন। বিড়ি খাইতে চাইলে কইবেন। বাকি নিয়া টেনশন নাইকা! আল্লা যত্তদিন রাখব, মাইষের খেদমত করমু।
আমি সিগারেট হাতে বসে আছি। সাবিলা একটু আগে ফোন দিয়েছিল, ধরি নি। এখন আর না ধরে থাকা যাচ্ছে না। ভালোবাসার দায়িত্ব থেকে কাজটা করছি বলে মনে হচ্ছে না। ফোন আসলে না ধরার মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করার দরুন ফোন ধরতে হয়। আমি ফোন ধরামাত্রই সাবিলা উৎসবের বন্যায় ভেসে ভেসে বলল, শোনো, একটা অফার আছে।
কি অফার?
লঞ্চে ফিফটি পারসেন্ট ছাড়ের অফার। শুধুমাত্র প্রেমিক প্রেমিকা এবং স্বামী স্ত্রী-দের জন্য এক বিশাল অফার। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়বে। সোজা যাব বরিশালে। অফারটা লঞ্চ করে যাওয়া, আবার এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা ব্যাক করলে ফিফটি পারসেন্ট ছাড়েই আসা যাবে। বরিশাল কেমন, তা তো তুমি জানোই। বাঙলাদেশের 'ভেনিস' বলা হয়। ইশশ, কতদিনের ইচ্ছে ছিল! তুমি তো নিয়ে গেলে না, এবার অফারে চল যাই। ফার্স্ট ক্লাশ ডেকের টিকিট কেটে ফেলব এখন। কি বল? পরশু ট্যূর।
আমি অনাগ্রহের সাথে বললাম, না গেলে হয় না?
একদম না। না গেলে আর কখনওই তুমি আমার সামনে আসবে না। আমি মনে করব, আমার কোনওদিন কোনও প্রেমিক ছিল না। ছিল Not enemy -এর মতো কেও একজন। বাবাকে গিয়ে সরাসরি বলে দিব, বাবা, তোমার পছন্দের পাত্রের সাথে আমি বিয়ে করব। বাবার কিন্তু পছন্দ করা ছেলে আছে। নাম মুরাদ। বিশাল হার্ডওয়্যার কম্পানির মালিক। লাখ লাখ টাকা ইনকাম করে, তোমার মতন বিছানা সাহিত্য রচনা করে কাগজ আর কলমের উপর জুলুম করে না। দ্যাখতেও বেশ ভালো। চুল কাটে, সেভ করে; তোমার মতন রবীন্দ্রনাথ ভড়ং ধরে না তো! আমি বাবাকে বলে দিলেই ওর সাথে আমার সামনের মাসে বিয়ে ফাইনাল।
আমি সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিয়ে বললাম, তোমরা সুখী হও। দোয়া এবং ভালোবাসা রইল। হার্ডওয়্যর কম্পানির মালিকের সাথে বরিশাল যেয়ো।
ওপাশে পিনপতন নিরবতা। সব নৈশব্দের ভাষা নেই। অনেকে নৈশব্দ আর নিস্তব্ধতাকে এক করে ফেলে। এটা ঠিক না। নৈশব্দ হলো প্রকৃতির রঙ, নিস্তব্ধতা হলো মানবের রঙ। মানুষ কখনওই প্রকৃতিকে ছুঁতে পারে না, প্রকৃতিই আমাদেরকে ছোঁয়। অপরূপ গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন মানুষের দ্যাখা পেয়ে অপরূপ হয় নি। বরং মানুষই তার দ্যাখা পেয়ে বিশালতায় বুক ভাসিয়েছে। কিছুক্ষণ পর সাবিলা ফোন রেখে দিল। তার ফোন রাখার ধরনটা ব্যতিক্রম এবং বিরক্তিকর। সে অন্য প্রেমিকাদের মতন খট করে ফোন নামিয়ে রাখে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, রাগে ফুঁসতে থাকে, এবং সে যে রাগে ফুঁসছে, তার মৃদু শব্দটা ওপাশের ব্যক্তিটির কর্ণগোচরে প্রবেশ করিয়ে দেয়াটাকে সে ভয়ানক তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করে। সিগারেট শেষ করতে না করতেই সাবিলার মা ফোন দিয়ে বসলেন। হাসিমুখে জানালেন, বাবা, ভালো আছো?
জি। আপনাকে আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। তুমি নাকি সাবিলাকে কাঁদিয়েছো। কি হয়েছে বাবা?
কৈ আন্টি, কিছু না তো! কাঁদছে নাকি?
হ্যাঁ বাবা, প্রচণ্ড কাঁদছে। আমি নুডুলস নিয়ে রুমে গেলাম, সব নুডুলস এখন আমার মাথায়। কি ব্যাপার বাবা? ঘটনা কি?
আমি স্বাভাবিকভাবে হেসে বললাম, সাবিলা নাহয় রাগ করে আপনার মাথায় নুডুলস ঢেলে দিয়ে বরবাদ করেছে, তা সেই নুডুলস এখনও আপনার মাথায় কেন, তা তো বুঝলাম না। মাথা ধুয়ে এসে ফোন দিলেও তো পারতেন। সাবিলা রাগ করলে ফোঁপানীর আওয়াজ শোনায়, এটা কি আপনার থেকেই ধার করা, মাথায় নুডুলস রেখে ফোনে কথা বলার মতন...?
বেয়াদবের মতন কথা বলবে না। বাসায় এনে ভালো করে খাইয়েছি বলে মাথায় উঠে বসেছো?
আমি নুডুলসের উপরে বসি না।
ওপাশে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। আন্টি নিরবতা ভঙ্গ করলেই আমাকে অজস্র গালি শুনতে হবে। মহিলারা গালি দিতে পারেন না -বলে প্রচলিত ধারণায় আমি অবিশ্বাসী। অনেক মহান নারীও নাকি গালাগালি করে তৃপ্ত হতেন। যেমন- ক্লিওপেট্রা। সেখানে আন্টি করলেও কোনও অপরাধ দ্যাখি না। আন্টি খুব নরম সুরে বললেন, মুরাদ কিন্তু খুব ভালো ছেলে।
ও আচ্ছা।
পড়াশুনাতেও ভালো, তোমার মতন থার্ড ক্লাশ না।
তা তো বটেই, তা তো বটেই।
বিশাল কম্পানি তার।
বেশ ভালো খবর।
তার বাবা আবার ইঞ্জিনিয়ার। তোমার বাবা কি যেন?
মসজিদের মুয়াজ্জিন।
হা হা হা! ওর আর তোমার মধ্যে ব্যবধান অনেক।
মাশাল্লা!
ওর সাথে সাবিলার বিয়ে হলে সাবিলার কোনও কষ্ট থাকবে বলে মনে হচ্ছে?
না, একেবারেই না।
কবি সাহিত্যিকদের থেকে বিজনেসম্যানরা অনেক স্মার্ট, জানো বোধহয়?
১০০% সহমত। রবীন্দ্রনাথ গা থেকে হুরহুর করে তামাকের গন্ধ আসতো।
এই তো, কবিরাও জানে, তারা অধম। তাই নয় কি?
কথাটা মনে লেগেছে। যে কবি জানে না, সে অধম; তার কবিতা লেখাই পাপ।
তবুও সাবিলা নিতান্তই পাগল বিধায় তোমাকে পছন্দ করে। এটা তোমার সাত জনমের ভাগ্য।
চৌদ্দ জনমের ভাগ্য!
আন্টি শক্ত গলায় বললেন, বাড়াবাড়ি করবে না।
জি আচ্ছা।
সাবিলা তোমার সাথে বরিশালে ঘুরতে যেতে চায়, কুয়াকাটা না আরও কোথায় কোথায় যাবে বলল; তোমার উচিত চলে যাওয়া। টাকা পয়সা মেটার করে না। আমি টাকা দিব সম্পূর্ণ। তোমার তো আবার ইনকাম বন্ধ। তুমি যাবে?
জি না।
কেন, জানতে পারি?
এখানে আমার কোনও কন্ট্রিবিউশন নেই। তাছাড়া আরেকজনের হবু বৌয়ের সাথে রাত কাটানোটা ভালো না। পরে বিজনেসম্যান মুরাদ বলবে, সাবিলা বাজারী মেয়ে। বিয়ের পর ঝগড়া হলেই মুরাদ দাঁত মুখ কুঁচকে শক্ত গলায় বলবেন, চুপ করো, বিয়ের একমাস আগে কোন ছেলের সাথে কুয়াকাটা গেছো, কত রাত থেকেছো, তা আমাকে শেখাতে আসবে না। তোমাকে সারা কুয়াকাটার মানুষ চিনে। তুমি ভালো হও কি করে?
ওপাশে আবার কিছুক্ষণ নিরবতা। আন্টি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে খুবই শান্ত গলায় বললেন, বাবা ইমু, রাগ করে অনেক কথা বলে ফেলেছি। তুমি মাইন্ডে নিও না। তুমি ওর সাথে কুয়াকাটা যাও। মুরাদের সাথে ওর বিয়ে আমিই দিচ্ছি না। সাবিলার বাবার কথা এখানে অগ্রহণযোগ্য। ও হ্যাঁ, ভালে কথা! মুরাদের মায়েরও রেড কালারের ব্লাউজ চুরি হয়ে গেছে। সেইদিন থেকেই বিয়ে ক্যানসেল প্রায়। মুরাদের বাবা অবাক হয়ে দ্যাখলেন, বিয়ের আগেই যদি মুরাদের শ্বশুর তার স্ত্রীর ব্লাউজ চুরির মতো নিকৃষ্ট কাজ করতে পারেন, তবে বিয়ের পর তো রোজ আসা-যাওয়ার দরুন তার স্ত্রীকে এই খাস লুচ্চাটা গর্ভবতীও করে ফেলতে পারে! কি অবস্থা হয়েছে দ্যাখো! তুমি যাচ্ছ তাহলে?
আসলে আমার হাত তো...
ওটার ব্যবস্থা আমি করব বলেছি তো। কন্ট্রিবিউশন নিয়ে ভাববে না। আমার টাকা তোমার টাকা একই জিনিশ। লাউ আর কদু। আর ধরতে পারো, এটা তোমার কবিতা লেখার জন্য গিফট।
আমি জহির সাহেবের বাসায় এসে বসেছি। তার স্ত্রী বিছানায় শুয়ে আছে। কেন জানি না, এই মেয়েটার উপর আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তার কারণে এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে। জহির সাহেবের এনিয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই। আমি আড়ালে-আবডালে অনেক করে জহির সাহেবকে ব্যাপারটা বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেছি।
আমি তার স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলাম। সে বরাবরের মতোই চুপ। আমি খুব নরম করে বললাম, জানো, তুমি একটা মেয়েকে স্বপ্নে দ্যাখেছো, যে আমার জীবনে এসে আমাকে একটা নূতন জীবন দিয়েছে...? আমাকে পূর্ণ ভবঘুরে থেকে সরাতে না পারলেও কিছুটা তো সরিয়ে গেছে। সেই মেয়েটাই আজ মারা যাচ্ছে, তাও তোমারই কারণে। আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানো?
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেতরে সাবধানী অনুশোচনা জাগ্রত হতে আরম্ভ করেছে। জহির সাহেব অবাক চোখে আমার কথায় রাগের পরিমাণ নিরূপণ করছেন। আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে চোখে কোনও জল নেই। কখনও কখনও চোখের কোণে জল জমা না হওয়াও চোখ ভিজিয়ে কাঁদার চাইতে অর্থবহ ভূমিকা রাখে। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো করে এই প্রথম বলল, আমি জানি, স্বপ্নে দ্যাখা মানুষটাকে আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু সত্যি বলছি, ডাক্তার বলেছেন, আমি অতিশীঘ্রই ভালো হয়ে যাব। আমি আর বোধহয় স্বপ্নে একজন বা দুজনকে দ্যাখব। সত্যি বলছি, এরপর থেকে আমি সুস্থ।
* শেষ পর্ব
সাবিলার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। লঞ্চের নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। একটা হলেই হলো! বেশ কিছুদিন পূর্বে 'পিনাক-৬' নামে একটা লঞ্চ ডুবে গিয়েছিল। সেই ভীতিটা আমার মনে সামান্য কাজ করছে। একটা অদ্ভুত সুন্দরী মেয়েও সেই দুর্ঘটনায় মারা যায়। তবে যে দৃশ্যটা দ্যাখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি, তা হলো, একটা নবদম্পতির লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল; তারা দুজনেই জড়াজড়ি অবস্থায় ছিল। সাবিলা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সে অবশেষে আমাকে আনতে পেরে সফল হয়েছে, সেই হাসিটাই ঠোঁটে-চোখে লেগে আছে।
একটু আগে আমি একটা গূঢ় সত্য জেনেছি। সাবিলা বলেছিল, জানো, হার্ডওয়্যার কম্পানীর মালিক মুরাদের মায়ের ব্লাউজ চুরি হয়েছিল?
জানি। রেড কালারের।
কে চুরি করেছে জানো?
এত মহান জিনিশগুলো কে চুরি করে, জানব না...?
সাবিলা হি হি করে হাসতে হাাতে বলল, আসলে আমিই চুরি করেছিলাম। দোষ দিয়ে দিয়েছি বাবার উপর। যেন বিয়েটা ভেঙে যায়।
আমি চূড়ান্ত অবাক হওয়া চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবে বললাম, ও আচ্ছা!
প্রথম রাতটা কেবিনে শুয়ে কাটানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সাবিলার জোরাজুরি-তে লঞ্চের ছাদে পাটি বিছিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমার এতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কেবিনের টিকিট না কাটলে ছাদে ঘুমানো যায়। কিন্তু টিকিট কাটার পরও ছাদে ঘুমাতে হলে টিকিটকে অবমাননা করা হয়, অস্বস্তিও হয়।
লঞ্চে অনেক ধরনের 'কাপল' উঠেছে। একটা বিখ্যাত কলেজের ম্যাডামও এসেছেন। তাঁকে আমি হালকা হালকা চিনি। তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিল যার সাথে, সেই ভদ্রলোকের সাথেও আমার সম্পর্ক আছে। কিন্তু ভদ্রমহিলা এখন অন্য একটা সুপুরুষের সাথে কুয়াকাটা যাচ্ছেন। বর্তমান বাঙলাদেশ অনেক আধুনিক হচ্ছে। সামনে পেছনে মেয়ে বা ছেলে রাখাকে কৃতিত্বের সাথে দ্যাখছে। যে মেয়েটা ক্লাশে সবচে' সেজে-গুজে আসে, তার ফলোয়ার বেশী।
লঞ্চ অফারে নবদম্পতি আসার কথা ছিল, কিন্তু বেশ কয়েকজন বুড়ো বুড়িকেও দ্যাখেছি। শীত পড়ার কারণে বিকালে এক বুড়ি আমার থেকে একটা চাদর নিয়ে আর ফেরত দেন নি। বুড়ো বয়সে সবকিছুকে একান্তই নিজের ভাবতে ভাল লাগে। লঞ্চটা বেশ বড়সড়ই। খাবারের মানও যথেষ্ট। না আসলে একটা ভুল করে বসতাম। সবকিছু চেখে দ্যাখার নেশা খুবই প্রয়োজনীয় নেশা। এই নেশাটা যার মধ্যে যত প্রবলভাবে থাকবে, সে তত সামাজিকভাবে দক্ষ হয়ে উঠবে।
আমি সাবিলার পাশে বসে আছি। লোকেশন- লঞ্চের ছাদ। একটু আগে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এসেছিল, ধরি নি। এখন আবার আসছে। নিতান্তই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনটা তুললাম। ওপাশ থেকে একজন মহিলা খুব করুণ সুরে বললেন, তুমি ইমু না?
জি।
আমি সুপ্তিকার মা।
কেমন আছেন আন্টি?
আন্টি নিশ্চুপ।
কথা বলছেন না কেন?
জানো, সুপ্তিকা মারা গেছে...?
জি না। কখন চলে গেল?
উনি বোধহয় এই প্রশ্নের জবাবে সিমপ্যাথি টাইপ কোনও কথা আশা করেছিলেন। কষ্টে থাকলে সবার থেকে সিমপ্যাথি পেতে ভালো লাগে। আন্টি ধরা গলায় বললেন, গত পরশু। তোমাকে একটা জিনিশ দিতে চেয়েছিল। কাগজে কি যেন কি লিখেছে, আমি দ্যাখি নি। তুমি একবার কুষ্টিয়া আসবে?
আচ্ছা আসব। তবে আমি এখন কুয়াকাটা যাচ্ছি। লঞ্চে ফিফটি পারসেন্ট ছাড়ে প্রেমিক প্রেমিকা এবং স্বামী স্ত্রীদের একটা অফার চলছে। বেশ ভালো অফার! প্রথমে ভেবেছিলাম আসব না, এখন এসে দারুণ লাগছে। আচ্ছা শোনেন, ভালো একটা কথা মনে পড়েছে। লঞ্চে উঠার আগে আমি একটা শিউলি গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা জিনিশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, পৃথিবীর সব ফুল ফুটলে সুন্দর লাগে। তবে ফুলের গোত্রের মধ্যে একমাত্র শিউলি ফুলই ঝরে গেলে সুন্দর লাগে...
আন্টি ফোন রেখে দিলেন।
সাবিলা নদী দ্যাখছে। তার অতদিকে মন নেই। আমি কার সাথে ফোনে কথা বলব কি বলব না, এটা আমার ব্যাপার। অন্য প্রেমিকাদের মতন সে এসব তুচ্ছ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। তার কাছে ভালোবাসাটা বিস্তৃত একটা ব্যাপার। একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে তাকে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমি লালন বাবার দরবারে। ফোনে হঠাৎ টাকা শেষ। একটা জরুরী ফোন করতে হবে। আবার বাবার এই গানের আসর ছেড়েও যাওয়া যাচ্ছে না। সাবিলা এই বিপদের সময়ে রাত বারোটার দিকে সারা শহরের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমার ফোনে টাকা রিচার্জ করে দিয়েছে। আবার কয়েকদিন আগে ইমার টিউশনি হারিয়ে বেশ অর্থকষ্টে দিনগুজরাচ্ছি। রিচার্জ দোকানে গিয়ে নম্বর লেখালাম। মোবাইলে বিশ টাকা না থাকলেই নয়! দোকানদার টাকা দিতে যাবেন ঠিক এই দুঃসময়ে সাবিলা ফোন করে বলল, তোমার নম্বরে এই মুহূর্তে ত্রিশ টাকা পাঠিয়েছি, পেয়েছো...?
ভালবাসার সাথে বোধহয় অলৌকিকতার কোনও যোগসূত্র আছে। নাকি সম্পূর্ণ ভালবাসা-টাই অলৌকিক? জহির সাহেব ফোন দিয়েছেন। আমি সাবিলার দিকে তাকিয়ে আছি। ফোনটা ধরা উচিত। জহির সাহেবের ফোন, ভয় ধরিয়ে দেবার ফোন। তার স্ত্রীর কারণে আমার এতদিনকার বান্ধবী সুপ্তিকা মারা গেছে, এই দুঃখ আমার কখনওই যাবে না। জহির সাহেব ফোন দিয়ে চুপচাপ করে বসে থাকলেন। তিনিও বোধহয় নিস্তব্ধতা পছন্দ করেন। অথবা আমি নিস্তব্ধতা পছন্দ করি বলেই কি আমার সাথে কেবল এমন হয়? জানি না। আমি শান্ত গলায় বললাম, জহির সাহেব।
তিনি খুবই মিহি গলায় বললেন, জি?
আপনার স্ত্রী কেমন আছে?
ভালো না।
জানা কথাই। সে এখন কোথায়?
আমার পাশে।
ও আচ্ছা।
জহির সাহেব ফোন হাতে বসে আছেন। সাবিলা আমার হাত ধরে রাতের এই পরিবেশটা উপভোগ করছে। খুব বেশী স্পেশাল কিছুই নেই এতে। নদীর পাড়ে রাত, চাঁদ, তারা আর নৈশব্দ যেমন; লঞ্চের উপরও তেমন। শুধু পার্থক্য এই, মনে হয় যেন, আমি এখন লঞ্চের উপর না, নদীর উপর। জহির সাহেব খুব শীতল গলায় বললেন, ভাই?
আছি।
সাবিলা কোথায়?
আমার পাশে।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ওকে ভালবাসবেন। এটা উচিত। যারা আমাদেরকে ভালবাসে, তাদেরকে আমাদের ভালবাসতে হবে। আমরা যাদেরকে ভালবাসি, তাদেরকে ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। কারণ তারা কখনওই আমাদের হবে না। পৃথিবীটা খুব ছোট, টিভির সমান। জীবনটা আরও ছোট, রিমোটের সমান। আমরাই কিন্তু পৃথিবী চালাই, পৃথিবী আমাদের না।
জহির সাহেব?
জি।
কিছু হয়েছে?
জি না।
জহির সাহেব বেশ আনন্দিত কণ্ঠে বললেন, জানেন আমাদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছিল?
না তো।
জহির সাহেব অনেকদিন কারও সাথে কথা বলেন না। আজ একটি ফুরসুত পেয়ে আমাকে ছাড়ছেন না। তিনি ধীর গলায় গত ক্যালেন্ডারের স্মৃতিচারণা করে বলতে থাকলেন, আমি ওকে প্রাইভেট পড়াতাম। তখন খুব কষ্টে ছিলাম। একা থাকতাম, তবুও প্রথম স্ত্রীর সাথে কিছু ঝামেলা চলছিল। ওকে আমি 'মিনা' বলে ডাকতাম। ক্লাশ নাইনে পড়ত ও। আমার সাথে পড়া বাদে সারাদিন ইটিশ-পিটিশ করত। টেবিলের নিচে পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি দিত। আমি ভাবতাম, বেয়াদব মেয়ে! পরে দ্যাখলাম, প্রেমিকা মেয়ে! আমাকে একদিন ধরে বসে বলল, আপনাকে আমি বিয়ে করব। দিলাম একটা থাপ্পড়। অইদিন সে আর পড়া করে নি, কাঁদতে কাঁদতে ভেতরের রুমে চলে গিয়েছিল। এর বেশ কিছুদিন পর তার বাবা আমাদের বিয়ে দিয়ে দেন। আমি পুরােই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! আমি পড়াতে গিয়েছি, তিনি ধরে আমাদের কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। আর আমার দিকে তাকিয়ে পান চিবানো লাল দাঁত বের করে মিটমিট করে বললেন, লুইচ্চা মাষ্টার!
বাসর রাতে মিনা হি হি করে হাসছে। আমি তখনও ভাবতে পারছি না, আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মিনা হাসতে হাসতে বলল, শোনো, বাবার উপর রাগ করো না। উনি তোমাকে ভুল বুঝেছেন। আসলে আমি তোমাকে ভালবাসি তো, তাই বাবাকে বলেছিলাম, আমি প্রেগন্যান্ট। আর আমার বাচ্চার বাবা তুমি। হি হি হি! এবার তুমি যদি আমাকে থাপ্পড় দিতে চাও, তো দিতে পারো। এই নাও গাল। আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে সেরাতের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মিনার সেক্স ভীতি ছিল। আমি ভাবতাম, ছোট মেয়ে। আসলে ঘটনা অন্য জায়গায়। ছোটবেলায় ও ধর্ষিত হয়েছিল চাচার কাছে। তাই তার এই সেক্স ভীতির শুরু। এই কথাটা শোনার পর তার চোখের জল দ্যাখে মনে হয়েছিল, আমি তাকে ভালবাসি। যদিও Sex is a basic need. তবুও আমি সেটা বাদেই মিনাকে ভালবাসি।
আমি সিগারেট ধরালাম। আমার পাশে সাবিলা। ও বিরক্ত হলে সেটাই যৌক্তিক। কারণ এতক্ষণ তার পাশে বসে মোবাইলে কথা বলা সমীচীন হচ্ছে না। আমি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললাম, জহির সাহেব।
জি ভাই?
আপনি অনেক ভালো মানুষ।
একদম না। মিনা অনেক ভালে মেয়ে। আমি আমার সারাজীবনের বিনিময়ে হলেও তাকে চাই।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। আমিই প্রথম নিরবতা ভঙ্গ করে বললাম, জহির ভাই?
জি?
গতরাতে মিনা স্বপ্ন দ্যাখেছে?
দ্যাখেছে।
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিলাম। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, আমি এখন একজন আসামি। রায় শোনার অপেক্ষায় আছি। 'কাকে?'
জহির সাহেব চুপ।
বলেন।
তিনি নিস্তব্ধতার সাথে সতীন।
বলে ফেলাই ভালো।
জহির সাহেব বোধহয় এই প্রথম কান্না চাপছেন। তার কান্না চেপে ধরে রাখাটা অনেকটা অপেশাদারিত্ব মনে হচ্ছে। তিনি বিপর্যস্ত গলায় বললেন, ও গতরাতে দুজনকে স্বপ্নে দ্যাখেছে। এদের মধ্যে... একজন... ইয়ে... মানে, একজন হচ্ছে সাবিলা।
আর বাকিজন?
জহির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মিনা স্বয়ং।
আমি ফোন রেখে দিলাম। লঞ্চ অনেক দ্রুত চলছে না, আবার আস্তেও চলছে না। পৃথিবী 'পারফেক্ট' বলে কোনওকিছুকে পছন্দ করে না, আমিও না। তবে এই মুহূর্তে লঞ্চের এই পারফেক্ট গতিকে ভীষণ পছন্দ করছি। আমি সাবিলার দিকে তাকিয়ে আছি। সে হঠাৎ ভীষণ খুশি হয়ে বলল, তুমি একটা ধাঁধাঁ বলেছিলে না, কোন জিনিশ যত বড় হয়, তত ছোট হয়। অইটার উত্তর আমি বের করেছি। বলব?
বল।
জীবন। জানি না সঠিক কিনা। জীবন যত বড় হবে, মৃত্যু তত ঘনিয়ে আসবে, বা, ছোট হবে। আমি আমার মতন করে উত্তর দিয়েছি। সত্যটা জানি না, জানতেও চাই না।
আমি তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলাম। হাতের প্রায় গোটা সিগারেট-টা ফেলে দিলাম, কারণ সাবিলার তা অপছন্দ। আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তোমার উত্তরটা কারেক্ট। এটাই চাই আমি। আমরা সবাই সঠিক, কেও ভুল না। কেও বলে পূর্ণ চাঁদ, কেও জ্যোৎস্না। আচ্ছা সাবিলা, একটা গান শোনাবে...?
সে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিল। গায়িকা-রা গলা খাকড়ি দিয়ে গান শুরু করে। সাবিলা এটা করে না, বোধহয় তার গলা তার মনের মতোই পরিষ্কার। সে গান ধরেছে, এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে,
এসো না গল্প করি।
দ্যাখো অই ঝিলিমিলি চাঁদ, সারারাত আকাশে শলমা জরী।
এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে...
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু সেখানে চাঁদ নেই। কোনও জ্যোৎস্না নেই। কিন্তু এই নদীর মাঝে আমি ভিজে যাচ্ছি, আমার অঙ্গ ভিজে যাচ্ছে, সাবিলার 'জোছনায়'...
সমাপ্ত
* কমেন্ট বক্সে অবশ্যই কমেন্ট করে
জানাবেন গল্পটি কেমন লাগব.....ধন্যবাদ *