" মুটি বউ Vs জেদী বর "
লেখিকা : Asstha Rahman
পর্ব :১
ব্যালকুনিতে কফি কাপ হাতে পায়চারী করছে ঈশান।খুব মন খারাপ নিয়ে মাঝে মাঝে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ইচ্ছে করছে এখনি পালিয়ে যেতে। বিয়ের বর কখনো পালায় কিনা তা ওর জানা নেই! কিন্তু সেই পথও বন্ধ।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মি. শাহের রহমানের ছেলে ঈশান।বিদেশ থেকে স্টাডি কমপ্লিট করে সদ্য দেশে ফিরেছে।ফিরতে না ফিরতেই দেখে সবাই তার বিয়ের আয়োজন করে বসে আছে। বাবাকে অনেক বলেছে সে এই বিয়েতে রাজী না।সে আব্রিকে খুব ভালোবাসে।বিয়ে করলে তাকেই করবে।
এমন সময় ঈশানের মা ফারিয়া বেগম এসে তার মাথায় হাত রাখলেন..
--মা, প্লীজ তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বল না! আমি এই বিয়ে করব না।
--তুই জানিস আমি তোর বাবার মুখের উপর কখনো কথা বলিনা।তোর বাবা যা করছেন তোর ভালোর জন্য করছেন।
--কিসের ভালো মা? আমার পছন্দ গুরুত্ব দিচ্ছেনা।এমনকি আমার পাসপোর্ট ও কেড়ে নিয়েছে।মা আমি এই বিয়ে করতে পারব না।
মি. শাহের আড়াল থেকে সব শুনছিলেন।তার জানা ছিল তার ছেলে এই বিয়েটা না হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করবে।কিন্তু তিনি যে তার বন্ধুকে কথা দিয়েছে তার বন্ধুর মেয়েই তার একমাত্র ছেলের বউ হবে।তিনি তো তার কথা নড়চড় হতে দিতে পারেননা।
তাই ব্যালকুনিতে এসে মা-ছেলের কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বললেন,
--বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। ঈশান বাবার এমন হঠাত উপস্থিতিতে ভয় পেয়ে যায় তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,,
--বাবা প্লীজ বুঝার চেষ্টা করো।আমি একজনকে খুব ভালোবাসি।
--আমি আগেও বলেছি,এখনো বলছি কোনো বিদেশে থাকা মেয়েকে আমি আমার ঘরের বউমা করবনা।
-- বাবা,ও বাংলাদেশি।তুমি একবার ওকে দেখো,কথা বলো।তুমি বুঝতে পারবে ও খুব ভালো মেয়ে।
--নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে যে বিদেশী হয়ে উঠার জন্য তৎপর,সে যাই হোক বাংলাদেশি হতে পারেনা। বলছিলে না পাসপোর্ট কেন নিয়েছি?
আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি তুমি ওই মেয়েটার সাথে পরামর্শশ করে বিদেশ ফিরে যেতে চাচ্ছো।
আর কিছু শুনতে চাইনা আমি,
তুমি আমার পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করবে।যদি তা না করো তবে আমি তোমায় ত্যাজ্যপুত্র করব।
এমন কথা শুনে ফারিয়া বেগম ভয় পেয়ে যান।তার স্বামী এক কথার মানুষ।তাই ঈশানকে চুপ থাকার ইশারা দেন।
ঈশান কিছুতেই ব্যাপার টা মেনে নিতে পারছেনা।কিন্তু সে কি করবে? কাল তার বিয়ে। কোনো ভাবেই আটকাতে পারল না।সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে,, মানুষ আসা শুরু হয়ে গেছে।পুরো বাড়ি যেন উৎসবে মেতেছে।নানানরং এর আলোয় বিশাল বাড়ীটা ঝকমক করছে।
একটু পর তার হলুদ ছোঁয়া।মা এসে নতুন পাঞ্জাবি দিয়ে রেডি হতে বলে গেল।
রোবটের মত সেগুলো পরে নিয়ে রুমে বসে আছে। এমনসময় তার ছোট বোন ঈশিকা রুমে ঢুকলো..
--ভাইয়া! নিচে চল সবাই তোকে ডাকছে।
--আমার এসব ভাললাগছেনা। তুই যা।
--চল না,,বাবা কিন্তু খুব বকবে।
অতঃপর নিরুপায় হয়ে ঈশান স্টেজে গিয়ে বসল।একেক জন একেক রকম মজা-তামাশা করছে।বিরক্ত লাগছে তার।
ঈশানের বেস্টু নাহিয়ান পাশে বসে বলল,,
-- আরেহ,শালা। বিয়ে করে নিচ্ছিস?
--হুম
--শুনলাম ভাবি নাকি একটু মুটু।
এই কথা শুনে ঈশানের মেজাজ হট হয়ে গেল।
-- কি বলছিস?
-- সত্যি বলছি দোস্ত। তুই মেয়ে দেখিসনি?
-- না দেখিনি।
-- বাহ না দেখেই বিয়ে। বেশ ভালো জমবে
ঈশান আর কথা বাড়ালোনা। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিল।মুটু মেয়ে তার খুবি অপছন্দ।একে তো জোর করে বিয়ে তার উপর তার হবু বউ মুটি। অসহ্যকর ব্যাপার.....
পর্ব : ০২
খুব শোরগোলে ঈশানের ঘুমটা ভেঙে গেল। বাসা ভর্তি অনেক মানুষ। খুব বোরিং ব্যাপারটা। পাজি কাজিনগুলা এসে তার সাথে ফাজলামি শুরু করে দিল,,ভাবীরাও সাথে যোগ দিল। কেউই ঈশানের অবস্থাটা বুঝার ট্রাই করছেনা।
দুলাভাইগুলা তাদের নিজের অভিজ্ঞতার গল্প বলা শুরু করে দিয়েছে। ঈশানের সেদিকে মন নেই।এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। সে উঠে ছাদে চলে এল।
-- হ্যালো আভ্রি। কাল রাত থেকে তোমার ফোন সুইচ অফ কেন?
-- আজ তো তোমার বিয়ে তাইনা ঈশ?
-- বিলিভ মি, আমি এই বিয়েতে রাজী না।আই জাস্ট লাভ ইউ। বাবা হুমকি দিয়েছে বিয়ে না করলে আমায় ত্যাজ্য করবেন তাই বাধ্য হয়ে সব মেনে যাচ্ছি। তবে আভ্রি তুমি বললে আমি এক্ষুণি বিয়ের আসর ছেড়ে পালাব।
-- তুমি বিয়েটা করে ফেল।
-- কি বলছো কি তুমি?
-- হুম,করে ফেল।ভেবে নাও এইটা একটা মিথ্যে বিয়ে। বিয়ের পর বাবার কাছে থেকে পাসপোর্ট নিয়ে সুযোগ বুঝে লন্ডন ব্যাক করবা।
-- কিন্তু এতে যে একটা মেয়ের লাইফ নষ্ট হবে!
-- তোমার কি মনে হয়, তুমি চলে আসার পর মেয়েটি তোমার জন্য বসে থাকবে? আজকালকার মেয়ে নিজের ধান্দা ঠিকিই খুঁজে নিবে। দরকার হলে কিছু ক্যাশ দিও।
ঈশানের এসব শুনে খারাপ লাগলেও ভাবে, ঠিকিই তো মেয়েটা তো আর বসে থাকবেনা। আর তাছাড়া আমি তো আভ্রিকে ভালোবাসি।এই মেয়েটাকে কখনো মানতে পারবনা।ঈশান আভ্রির কথায় সায় দেয়-- আচ্ছা,সেটাই হবে।
.
মি. শাহের বেশ খুশি। শেষ পর্যন্ত ধুমধাম করে ভালোই ভালোই বিয়েটা মিটলো। ঈশানও সবটা মেনে নিল।এবার বউমা আর ছেলে কে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বাসায় ফেরার পালা।
ঈশান গাড়িতে বসে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে যে তার বউ বসে আছে তার দিকে একবার ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয়নি।বাসায় এসেই ছাদে উঠে গেল।
কিচ্ছু ভালোলাগছেনা, মনে হচ্ছে সে খুব বড় ফ্যাসাদে পড়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর কাজিনরা এসে জোর করে রুমে নিয়ে বাহিরে থেকে দরজা লক করে দিয়ে চলে গেল। ঈশান এবার ভালো করে খাটে বসে থাকা মেয়েটির দিকে তাকাল। আসলেই তো তার বউ একটু মুটু। একটা গুলুমুলু ড্রাম বলা যায়। ৭০-৭৫ কেজি ওজন তো হবেই।
গায়ের রঙ মেকাপের জন্য বুঝতে পারছেনা।
দেখেই জেদ উঠে গেল।এমন একটা ড্রামের সাথে বাবা তার হ্যান্ডসাম ছেলের বিয়ে দিল।
ঈশান হালকা কেশে বলল,
-- আপনার নাম কি? মেয়েটি কাপা কাপা কন্ঠে উত্তর দিল, ফাওজিয়া আফরোজ স্মানূর.
-- আপনাকে কিছু কথা বলে রাখি। বিয়েটা আমি বাধ্য হয়ে করেছি, নাহলে আমার কপাল এত্ত খারাপ ছিল না যে নিজের সেক্সি ফিগারের গফ রেখে আপনার মত মুটি কে বিয়ে করব।
শুনেন স্মানূর, আপনি আমার সাথে বউয়ের অধিকার ফলাতে আসবেননা। ভুল করেও আমার থেকে কিছু আশা করবেননা।আর হ্যাঁ ৪ মাস পর আমি লন্ডন ব্যাক করব,তখন নিজের পথ খুঁজে নেবেন।এই কিছুমাস আপাতত বউয়ের অভিনয় করে বড়লোক বাড়ীতে রাজত্ব করে যান। এসব কথা যেন এই ঘরের বাহিরে না যায়।
-- হুম,আচ্ছা। আমি ফ্রেশ হয়ে নেই?
মেয়েটির ভাবলেশহীন উত্তরে ঈশান বিরক্ত হয়, কোনোরকম মুখ বাঁকিয়ে বলে, হুম।এসে নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়বেন। কারো জন্য আমি আমার খাট ছাড়তে পারবনা।
.
মাথা নাড়িয়ে স্মানূর ফ্রেশ হতে চলে যায়।ফিরে এসে দেখে ঈশান ঘুমিয়ে পড়েছে। তার গায়ে হালকা কাথা চাপিয়ে সেও নিচে শুয়ে পড়ে।
অজান্তে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বালিশে পড়ে যায়। স্মানূর তা মুছে নেয়।
কেউ জানতেই পারবেনা তাকে বাসররাতে চোখের পানি ফেলতে হয়েছিল। তার স্বপ্নগুলো চোখের পানির মত ঝরে গেছে.......
পর্ব: ০৩
ঈশানের মুখে রোদের আলো পড়তেই তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমচোখে উঠে দেখে কে যেন জানালার গ্রিল খুলে পর্দা সরিয়ে রেখেছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মুটিটাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা। " দূর,, ও না থাকলে আমার কি? আপদ একটা" এইসব বিড়বিড় করতে করতে ফ্রেশ হয়ে নিল।
তারপর নিচে ডাইনিং রুমে চলে এল। কাজিন, দুলাভাইরা এইখানে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছে। ঈশানকে দেখে টিপ্পনী কাটতে শুরু করল।ঈশানও ফাজলামি করতে করতে এক কোণে বসে পড়ল। মেয়েটা তো এইখানেও নেই। একরাতে উধাও হল নাকি?
.
হঠাৎ কিচেনের দিকে চোখ পড়ল। ঈশানের মুটি বউটা হলদে রঙের শাড়ি কোমড়ে গুজে লুচি বেলছে আর ভাবীদের সাথে হেসে হেসে গল্প করছে।
কাল রাতের শান্ত- ভাবলেশহীন রুপ আর আজ সকালের চঞ্চল রুপে কতটা তফাৎ।
-- এই নিন আপনার ব্ল্যাক কফি! স্মানূরকে কফি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশান চমকে উঠল,
-- ওহ, দিন। পাশে থাকা দুলাভাই বলে উঠল,
-- দেখো ঈশান তোমার বউ আসতে না আসতে তোমার পছন্দ জেনে নিয়েছে। কি ভাগ্য করে পেয়েছ? তোমার কাজিন তো বিয়ের পরের দিনই বলে, সে আমার চা খাওয়া অফ করে দিবে।
সবাই মিলে হেসে উঠল।স্মানূর চুপচাপ সেখান থেকে কেটে পড়ল।
ঈশান কফি শেষ করেই উপরে চলে এল। এইটুকুনু মেয়ের আদিক্ষ্যেতা ওর সহ্য হচ্ছেনা। সকাল সকাল নিজেকে জাহির করার জন্য কফি বানিয়ে দেখাল।
স্মানূর এইসময় রুমে ঢুকল নাস্তা নিয়ে।
-- নক করে ঢুকতে পারোনা? নিজের রুম ভেবেছো!
-- স্যরি, আপনার নাস্তা..খেয়ে নিন।
নাস্তা রেখে স্মানূর চলে যেতে উদ্ধত হল।
-- এই মুটি। স্মানূর চোখ বড় বড় করে তাকাল। ঈশান তা লক্ষ্য করে বলল, আমি তোমার এত্ত বিশাল নাম ধরে ডাকতে পারব না। মুটি বলেই ডাকব। আর শুনো, চোখ বড় বড় করছো কেন? মুটিকে মুটি বললে রাগার কি আছে। এসব রাগ আমাকে দেখিয়োনা।
স্মানূর কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। ঈশানের রাগ উঠে গেল, কি ভাব দেখাচ্ছে আমার সাথে? ভাব তোমার ছুটাচ্ছি!
.
সন্ধ্যে বেলা রিসেপশনে ঈশান তার ফ্রেন্ডদের সাথে গল্প করছিল। তখন স্মানূর সবে রেডি হয়ে নিচে নামছে।
ঈশানের বন্ধু নাহিয়ান বলল, দোস্ত তোর বউ নামছে।
ঈশান তাকিয়ে দেখল মুটি বউ আসছে। আজ হাল্কা সেজেছে। লাল রঙের বেনারশি পড়েছে! শাড়ি সামলাতে যে কস্ট হচ্ছে তা বুঝাই যাচ্ছে। সকালে আমার সাথে ভাব দেখানো তাই না? দেখাচ্ছি মজা।
ঈশান সরে এসে সিঁড়ির পাশে দাঁড়াল।
স্মানূর নামার আগে সে পা টা সামনে বাড়িয়ে দিল। স্মানূর হোচট খেয়ে নিচে পড়ার আগে নাহিয়ান ধরে ফেলল।
-- আরেহ ভাবী, সাবধানে নামবেননা।
-- শাড়ি সামলাতে একটু প্রোবলেম হচ্ছিল ভাইয়া তাই পড়ে গেলাম।
মি. শাহের এগিয়ে এসে বলল, বউমা তোমার লাগেনি তো?
-- না বাবা ঠিক আছি।
-- এসো, পরিচয় করিয়ে দেই সবার সাথে।
ঈশান রাগে ফুঁসছে জব্দ করতে গিয়েও পারলোনা।নাহিয়ানটা যে বেশী পাকামো করতে যায়।
রাত ১২টা বাজে।ঈশান ব্যালকুনিতে বসে আভ্রির সাথে ফোনে কথা বলছে। স্মানূর শোয়া থেকে একটু পর পর উঠে ঈশানকে দেখছে।
তার বরটা এত জেদী কেন? কি হয় আমাকে মেনে নিলে? না হয় একটু মুটি তাই বলে কি সে পুরোই ঈশানের অযোগ্য!
কোন বউ ই বা সহ্য করবে তার বর তার সামনে বসে অন্য মেয়ের সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত থাকলে!
উনি যদি সত্যি ভাবেন আমাকে নিয়ে উনি অসুখী, তবে আমি উনার কথামত এইখান থেকে চলে যাব!
ঈশান রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল। স্মানূরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
-- এই মুটি, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছো?
-- কিছু না তো।
-- কিছু তো একটা আছেই। জানো আভ্রিকে খুব মিস করছি
-- আভ্রি কে?
-- আমার প্রেমিকা। আমরা বিদেশে একসাথে স্টাডি করেছি। অনেক ভালো মেয়ে। খুব ভালোবাসি ওকে।
তুমি মাঝখানে না এলে তো ওকেই বিয়ে করতাম।
করতাম কি ৪মাস পর বিদেশে ফিরে ওকে বিয়ে করে ওখানে সেটেল হব।
-- বেশ ভালো....
পর্ব :০৪
স্মানূরের মুখটা থমথমে দেখে ঈশানের খারাপ লাগে। বুঝতে পারল তার খারাপ লেগেছে। কিন্তু ঈশানের তো কিছু করার নেই। ও এই মেয়ের সাথে সংসার করতে পারবেনা। ঈশান মৃদুস্বরে বলল,
-- তুমি কাউকে ভালোবাসো না?
-- হুম,বাসি।
-- তাহলে তো সমাধা হয়েই গেল। আমি চলে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে লাইফ শুরু করবা।
স্মানূর আর উত্তর দিলনা।অন্য পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। এসব কথার কোনো উত্তর হয়না।
.
ঈশিকা ছাদে উঠেই রেলিং এর পাশে ভাবীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-- ভাবী, বিকেল বেলায় একা একা ছাদে কি করছো?
-- চারিপাশ টা দেখছি।কত্ত সুন্দর হাওয়া, সবমিলিয়ে পরিবেশটা খুব সুন্দর।
ছাদটা এত্ত সুন্দর। রেলিং এ লতানো ফুল গাছ, সারি সারি ঝুলানো ঝাড়বাতি, দোলনা সব খুব ভাল্লাগে।
-- ভাইয়া ই সাজিয়েছে এভাবে। ওর ছাদ খুব প্রিয়। রাতে অধিকাংশ সময় ছাদেই কাটায়। জানো ভাইয়া রাতে দোলনায় বসে গিটারে সুর তুলে গান গায়।
-- তোমার ভাইয়া গান গাইতে পারে?
-- হুম খুব পারে। ও তো ভালো ছবিও আঁকে, ফটোগ্রাফিও করে মাঝে মাঝে।
-- খুব গুণী মানুষ তো তোমার ভাইয়াটা।
-- গুণী হলে কি হবে খুব জেদী, ঝগড়ূটে।
এসব বলে দুজনেই হাসতে লাগল।তখনি নিচ থেকে ফারিয়া বেগম ডাক দেওয়ায় দুজনেই নিচে নেমে গেল।
.
ঈশানকে অনেক ভালোলাগে। জেদী হলেও একটু ছেলেমানুষ টাইপের। কখন কি বলে বসে বুঝতেই পারেনা। আচ্ছা আমি কি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারিনা ওকে আমার করে নিতে?
শ্বশুড় আব্বু কত আশা নিয়ে আমাকে এই বাড়ীর বউ করেছেন।আম্মু,,ননদীটাও কত ভালো। এই কয়েকদিনে কত্ত আপন করে নিয়েছে।
সন্ধ্যেবেলায় আব্বু ডেকে বলল, তার ছেলেটা একটু ঠিক করে নিতে। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেছে যাতে তার ছেলেকে আগলে রাখতে পারি।
কি করে রাখব আমি? ক'টা মাস পেরুলেই যে আমাকে ছেড়ে উনি চলে যাবেন।
" এই মুটি" ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল স্মানূর। ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিল। হঠাৎ ঈশানের ডাকে তাই চমকে উঠল।
স্মানূর বেডের পাশে এসে বলল,
-- জ্বি বলুন। ঈশান একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বলল,
-- এই পেপারে সাইন করে দাও।
-- কিসের পেপার এটা?
-- কন্ট্রাক্ট পেপার। এই পেপারে লেখা আছে, ৪ মাস পর তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবে। আমার বা আমার পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখার ট্রাই করবানা।
স্মানুর হতভম্ব হয়ে গেল। কি ভাগ্য তার? বিয়ের ১ সপ্তাহ না হতেই তাকে ডিভোর্স এর পেপারে সাইন করতে হচ্ছে। ঈশান কড়াস্বরে বলল,
-- কি হল সাইন করো।
-- আচ্ছা করছি।
কাপা কাপা হাতে স্মানূর সাইন টা করে দিল। ঈশানের কাগজ টা নিয়ে ভালো করে দেখে রেখে দিল।
তারপর ফোন কানে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
পর্ব : ০৫
স্মানূর ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার টা ছেড়ে জোরে কাঁদতে শুরু করলো।কান্না লুকানোর জন্য এর থেকে ভালো জায়গায় ওর জানা নেই। অবিরত কেঁদেই চলেছে।
ঈশান ছাদে চলে এল। খারাপ তারও লাগছে। মেয়েটার থমথমে মুখটা দেখলে ওরও কান্না পেয়ে যাবে এমন মনে হয়।
-- সাইন করিয়েছো? ফোনের ওপাশ থেকে আভ্রির কন্ঠে তার ঘোর কাটে।
-- হুম করিয়েছি। কিন্তু আভ্রি ও তো বলেছিল ও চলে যাবে। তারপরো কেন এসব?
-- দেখো শেষ মূহুর্তে যে মেয়েটা বেকে বসবেনা তার গ্যারান্টি কি? বড়লোক বাড়ীর স্বাদ পেয়েছে বলে কথা! ওইসব মেয়েদেরকে আমার বিশ্বাস নেই।
-- ও কিন্তু এমন টাইপের না।
আভ্রি কড়া কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে যায়। তারপর কোমল কন্ঠে বলে,
-- আচ্ছা এমন না। তো সামান্য একটা সাইন করালে কি এমন হয়? জাস্ট সিকিউরিটির জন্য আর কি। আমার তো তোমায় নিয়ে খুব টেনশন হয় তাই সাইন করানোর জন্য জোরাজুরি করলাম। করিয়ে নিয়েছো এখন আমি নিশ্চিন্ত।
-- হুম,বেশ। আচ্ছা বাই। ফোনে চার্জ লো।
-- আচ্ছা ঈশ,পরে কথা হবে। টেক কেয়ার বেবি।
ইচ্ছে করেই মিথ্যে টা বলল ঈশান। তার এখন কথা বলার মুড নেই। মুটিটা কি করছে একবার দেখে আসা দরকার।
পিছন ফিরতেই দেখে স্মানূর দাঁড়িয়ে আছে কফি হাতে। মুখটা বেশ চুপসে আছে। চোখগুলা কেমন যেন লাল আর ফুলা ফুলা। চুল থেকে এখন ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে।
-- বুয়া আন্টি বলল আপনি কফি খেতে চেয়েছেন। তাই নিয়ে আসলাম।
-- হুম দাও। এই রাতের বেলায় শাওয়ার নিলা যে? চুলগুলাও তো ঠিক করে মুছোনি, জ্বরে পড়বা তো।
-- না কিছু হবেনা। আচ্ছা যাচ্ছি
-- ছাদে এসেছো যখন বসো একটু। দাঁড়াও তোমার চুলগুলা মুছে দেই।
-- না লাগবেনা। আমি মুছে নিতে পারব।
-- চুপ করে বসো।
চিলেকোঠার ঘর থেকে একটা পুরোনো তোয়ালে এনে ঈশান স্মানূরের চুল মুছে দিচ্ছে। চলেই তো যাব তাও কেন উনি মায়ায় জড়াচ্ছেন? ঈশান চুলটা ভালো করে মুছে দিয়ে বলল,
-- মন খারাপ করে আছো যে?
-- কই না তো!
-- গান শুনবা?
-- শুনাবেন?😍
-- হুম।
.
দোলনায় ফেলে রাখা গিটারটা তুলে নিয়ে টুং টাং সুর তুলে গান ধরলো,
" একটা গোপন কথা ছিল বলবার,
বন্ধু সময় হবে কি তোমার?
একবার শুনে ভুলে যেও বারবার
ভুলেও কাউকে বলো না আবার!"
স্মানূরের মনটা হালকা লাগছে। এত্তক্ষনের মন খারাপ ভুলে আকাশের চাদের সাথে পাল্লা দিয়ে মুচকি হাসছে।
স্মানূরকে হাসতে দেখে ঈশানের বিক্ষিপ্ত মনটা শান্ত হয়।মেয়েটাকে হাসলে দারুন লাগে।
-- মুটি?
-- হুম।
-- ঘুম পাচ্ছে?
-- না! আপনি গান থামালেন যে? আর একটু গাইবেন। ভালো লাগছে। ঈশান খানিকটা থেমে আবার সুর তুললো। এভাবে গল্পে,গানে কখন যে মাঝরাত হয়ে গেছে কেউ ই খেয়াল করেনি। স্মানূর ঈশানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।ঈশান হালকাভাবে গা নাড়া দিয়ে ডাকলো কিন্তু স্মানূর গভীর ঘুমে মগ্ন।
শেষমেষ কোলে করে ছাদ থেকে বেডরুমে আনতে হল।উফ! হাপিয়ে গেছে। সাধে কি আর মুটি বলে। তবে বয়ে আনার সময় ভারটা অত খেয়াল হয়নি।
যাই হোক, স্মানূরকে বেডে শুয়ে দিয়ে সে ব্যালকুনিতে এসে বসল।
.
স্মানূরের ঘুম ভাঙতেই বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করলো। ঈশান তার কিছুক্ষণ পর রুমে ঢুকে বলল,
-- ঘুম ভাঙলো তাহলে?
-- আমি বিছানায় কেন?
-- কাল রাতে ছাদেই তো ঘুমিয়ে পড়লে। কোলে করে বয়ে এনে বিছানায় শোয়ালাম
স্মানূর একটু লজ্জা পেল। তার বর তাকে কোল করে এনেছে। এমন স্বপ্ন তো সে বিয়ের আগে দেখতো। তার অজান্তেই তা পূরণ হল।
-- এই মুটি ব্যায়াম করবা। তোমার ভার বইতে গিয়ে পাক্কা ২০ মিনিট হাপানো লাগল।
-- হুম। বলে বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে স্মানূর টাল খেয়ে পড়ে যায়। ঈশান এসে গা ধরে দেখে জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। কাল রাতে তো মেয়েটা শাওয়ার নিয়েছিল। ঈশানও সারারাত এসি অন করে রেখেছিল। স্মানূরের ভার বয়ে তার গরম লেগেছিল।পরে সে ব্যালকুনিতে ঘুমিয়ে পড়ায় খেয়াল ছিলনা এসি অন রেখেছিল। এখন তো জ্বরে পড়ল মেয়েটা।
স্মানূরকে ধরে আবার বিছানায় শোয়াল।
-- আমি ঠিক আছি।
-- চুপ করো, জ্বর বাধিয়ে বসে আছো। কিচ্ছু বলোনি
বকা খেয়ে স্মানূর চুপ হয়ে গেল। ঈশান মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছে, স্মানূরের গভীর ভালোলাগা কাজ করছে। মি. শাহের জেনে ডাক্তার ডেকে আনলেন।ডাক্তার ওষুধ দিয়ে বিদায় নেওয়ার পর ফারিয়া বেগম সুপ বানিয়ে আনলেন। ঈশান অনেক যত্ন করে খাইয়ে দিল।
এখন তার মনে হচ্ছে তার জেদী বরটা তাকে খুব ভালোবাসে....
জ্বরের ঘোরে কতবার যে তার বরের বুকে মাথা রেখেছে, হাত জড়িয়ে ঘুমিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই ক'টা দিন তার কাছে পুরো স্বপ্নের মত।
ইশ! জ্বরটা যদি সারাজীবন থাকত।
এই সংসারে তার বেশ মায়া বসেছে। নিজের মা- বাবার মতই শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী তাকে ভালোবাসেন। জ্বরের পুরোটা সময় অনেক খেয়াল রেখেছে।
নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে! এমন ভাবনার সময় ঈশান এসে পাশে বসল। হাতটা নিজের হাতের মাঝে রেখে বলল, কেমন লাগছে এখন?
-- অনেক ভালো। জ্বরটা অনেক কমে গেছে।
-- তাও রেস্ট নাও।
-- আমার আর বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগছেনা।
ফারিয়া বেগম রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-- সেই তো। বিয়ের পর থেকে তো কোথাও বের হউনি।ঈশান তুই বরং ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আয়। দেখবি ও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
-- আচ্ছা। এই তুমি বিকেলে রেডি থেকো। স্মানূর হালকা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
পর্ব : ০৬
স্মানূর আলমারি খুলে এক এক করে সব শাড়ী নামাচ্ছে, একটাও ভালো লাগছেনা তার। আজ প্রথম তার জেদী বরটার সাথে বের হবে। একটু আলাদাভাবে সাজতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোনো শাড়িই তার মানানসই মনে হচ্ছেনা। ঈশান এসে স্মানূরকে একটা শাড়ির প্যাকেট দিল। স্মানূর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
-- এই মুটি হা করে তাকিয়ে আছো কেন? এটা পরে নাও।
-- আপনি আবার আনতে গেলেন কেন? আমার তো অনেক শাড়ী আছে।
-- হুম তাই তো আধঘণ্টা ধরে শাড়ি বাছাই করছো। তোমাদের মেয়েদের একটাই সমস্যা কোথাও যাওয়ার জন্য অনেক ড্রেস থাকলেও পরার জন্য একটাও পাও না..
-- হুহ, বলছে! ফুদাই মেয়েদের দোষ দেওয়া।
-- ফুদাই না। রেডি হয়ে নিচে এসো। আমি গাড়ি নিয়ে ওয়েট করব। বলে ঈশান গাড়ির চাবি নিয়ে বের হল।
ঈশান গাড়ি ড্রাইভ করেছে আর স্মানূর পাশের সিটে বসে আড়চোখে ঈশানকে দেখছে। চোখাচোখি হলেই দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। ঈশান লুকিং গ্লাসে স্মানূরকে দেখছে। কি সুন্দর লাগছে মুটিকে? লাল শাড়িতে তাকে বেশ কিউট লাগছে। তার উপর মুটির চোখ দুটো বেশ ডাগর ডাগর। চোখের বড় পাপড়িগুলা মেলে সে তাকলে নিজেকে সামলাতে কস্ট হয়।
কোন কবি যেন বলেছেন, সব মেয়েই এক একটা মায়াবতী। ঈশানের মনে হচ্ছে তার পাশে বসা শ্যামলা মুটিটা একটু বেশীই মায়াবতী।তার মায়ার প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে হয়।
নদীর পাশে এসে গাড়িটা ব্রেক করল। স্মানূর নেমে ছুটে গিয়ে নদীর কিনারায় দাঁড়ায়।
-- নদী খুব পছন্দ তাইনা মুটি?
-- হুম। কেন আপনার পছন্দ না?
-- হ্যাঁ ভালোলাগে অনেক। চল নদীর পাড়ে বসি।
-- আমার ভয় লাগে যদি পড়ে যাই?
-- আমার হাত জড়িয়ে বসলেও ভয় লাগবে?
-- উমহু। স্মানূর লজ্জাসমেত উত্তর দিল। নদীর পাড়ে বসে স্মানূর অনেক কথা বলছে অনর্গল। ঈশান চুপচাপ শুনছে, মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছে। বাতাসে স্মানূরের খোলা এক গোছা চুল মুখের সামনে এসে পড়ছে। স্মানূর বার বার সরিয়ে বকবক করে যাচ্ছে। ঈশান সেটিই দেখছে, কেন জানি চাচ্ছে এই দৃশ্য অনেকবার পুনরাবৃত্তি হোক।
-- মুটি?
-- হুম বলুন।
-- চোখ অফ করো তো?
-- কেন?
-- আহা! করোইনা।
স্মানূর চোখ অফ করতেই ঈশান নিজের হাতে বানানো লতা,ফুলের মুকুট স্মানূরকে পরিয়ে দিল।
-- এত্ত সুন্দর মুকুট।এটা কখন বানালেন?
-- তোমার বকবক শুনতে শুনতেই বানালাম। তুমি এত্ত কথা বলতে পারো আজ জানলাম।
-- এই শুনুন, আইসক্রিম খাওয়াবেন?
-- সবে তো জ্বর সারলো, এক্ষুণি খাওয়া লাগবেনা।
স্মানূর একটু মন খারাপ করে বলল, আচ্ছা।
তারপরো আজ সে খুব খুশি।
"এই মুটি, এই" ডাক শুনে স্মানূরের ঘুম ভাঙল। শোয়া থেকে উঠে দেখে ঈশান তাকে ডাকছে। উঠতেই ঈশান তাকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে আসল।হাতটা ছাড়তেই স্মানূর ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
-- কি ব্যাপার? মাঝরাতে ছাদে আনলেন যে?
-- বলছি। হাতটা বাড়াও।
-- আইসক্রিম! 😍😍 আমার ফেভারিট ফ্লেভার।
-- খাও। খেতে খেতে স্মানূর বলল, মাঝরাতে ডেকে খাওয়াচ্ছেন যে?
-- সেদিন খেতে চাইলেনা! তাই চমক দিতে এমন করলাম। এমন অদ্ভুত চমকের কথা শুনে স্মানূর শব্দ করে হেসে উঠল। ঈশান এক ঝটকায় স্মানূরকে টেনে বুকের কাছে টেনে আনল। স্মানূর অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নিজের দ্রুততর হওয়া হার্টবিটটা অনুভব করছে। ঈশান টিস্যু বের করে স্মানূরের নাকের ডগা মুছে দিয়ে বলল, এখনো আইসক্রিম খাওয়াটা শিখলানা মুটি।
-- কেন শিখিয়ে দেওয়ার মানুষ আছেনা?
-- আছে বুঝি?
-- মনে হয়। ঈশান স্মানূরের আরো কাছে আসতেই স্মানূর হালকা ধাক্কা দিয়ে নিচে নেমে গেল।
ঈশান পিছন থেকে মুচকি হেসে বলল, মুটি একটা😍
পর্ব : ০৭
স্মানূর মার্কার পেন ক্যালেন্ডারের তারিখে আরেকটা দাগ কাটল। দেখতে দেখতে অনেকগুলা দিন কেটে গেল।
৪মাস পুর্ণ হওয়ার আর মাত্র ১৫টা দিন বাকি। এতদিনেও সে ঈশানের মন পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। ঈশান ওর সাথে খুব ফ্রেন্ডলি বিহেভ করে, দুষ্টুমী করে কিন্তু কখনোই বলেনি সে স্মানূরকে বউ হিসেবে মেনে নিয়েছে।
এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে আভ্রির সাথে কথা বলে সেটা স্মানূরের চোখ এড়ায় না। কিন্তু যতদিন না স্মানূর স্ত্রীর অধিকার পাচ্ছে, এসব তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে।
তবে তার ভালো লাগাটা বেশী কাজ করে, যখন ঈশান তার মুখে সবসময় হাসি ফুটাতে সচেষ্ট থাকে।
এই মানুষটাকে কি করে ছেড়ে যাব?
বাকি ১৫টা দিনে তার মুখ থেকে যদি ভালোবাসি শব্দটা বের করতে পারি, তবে তাকে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন উঠবেনা।
শেষ চেষ্টাটুকু করি নিজের ভালোবাসাটাকে নিজের করে নেওয়ার।
ঈশান বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছে। স্মানূর এসে পাশে বসল।
-- মুটি, কি হয়েছে?
-- কই কিছুনা তো।
-- মন খারাপ?
-- মন খারাপ হবে কেন?
-- আম্মু,আব্বু আর ঈশিকা গ্রামে গেছে তাই বাসা ফাকা। ভাবলাম ওদের জন্য বুঝি মন খারাপ?
-- ৪ মাস হওয়ার আর মাত্র ১৫ দিন বাকি। ঈশান কথাটা আশা করেনি তাই সে নির্লিপ্ত হয়ে গেল। স্মানূর ঈশানের চোখে চোখ রেখে বলল,
-- এই কয়েকটা দিন আমার অপূর্ণ আবদার গুলা পূরণ করবেন? ঈশান কিছুটা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল,
-- কিসের আবদার?
-- বিয়ের আগে শখ ছিল বরের কাছে অনেক আবদার করব,সে তা পূরণ করবে। তাই ভাবলাম এই বিয়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আবদার গুলা করে নেই।
-- হুম করব।
স্মানূর উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল। বাহিরে টিপটিপ মাঝারি বৃষ্টি পড়ছে। সেটা দেখে নিজের অদম্য কান্নাকে সংবরণ করে নিল। ঈশানকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলেই তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।
-- ফুচকা খাওয়াবেন? ঈশান এত্তক্ষন স্মানূরের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। কথাটা শুনে অবাক হয়ে বলল,
-- এই সন্ধ্যালগ্নে বৃষ্টির মধ্যে ফুচকা খাবে?
-- হুম, চলুননা।
-- আচ্ছা চল।
স্মানূরকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ঈশান বের হল। মোড়ের মাথায় একজন ফুচকাওয়াল প্লাস্টিক টানিয়ে দাঁড়িয়েছিল। " যাক! ফুচকাওয়ালাকে পাওয়া গেল। মুটির মাথায় যে কি সব অদ্ভুত শখ চাপে!" ভাবতে ভাবতে দেখে মুটি অলরেডি ফুচকার প্লেট নিয়ে বসে পড়েছে।
-- এই ভিজে ভিজে খাচ্ছো কেন?
-- ভাল্লাগে। তুমি এসোনা! হা করো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
মুটির আবদারে ভিজে ভিজে ঝাল ঝাল ফুচকা খেতে হল। ফুচকার বিল দিতেই দেখি মুটিটা রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে ডাকছে।
যেতেই আমাকে নিয়ে টং এর দোকানে ঢুকলো। বেঞ্চিতে বসে এককাপ মালাই চায়ের অডার দিল। চা আসামাত্র হাতে নিয়ে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনি চুমুক দিন।
-- আমি চা খাইনা।
-- আরেহ খেয়ে দেখুন।
-- আচ্ছা আমি অডার দিচ্ছি।
-- না এককাপে আমার সাথে চা খাবেন। মুটির কথায় না করতে পারলামনা। বৃষ্টি দেখতে দেখতে পাশাপাশি বসে মুটির সাথে এককাপে চা খেলাম। ফিলিংসটা অন্যরকম।
এভাবে কখনো কোনো ফিলিংস হয় জানা ছিলনা। মুটিটার সব আবদারে আলাদা একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় এটাই শ্রেষ্ঠ অনুভূতি।
ঈশান ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে।স্মানূর পাশে এসে বলল,
-- আজ খুব জ্বালালাম তাইনা?
-- না তো।
-- কষ্ট করে সহ্য করে নিন। আর তো কয়েকটা দিন।
ঈশান কথাটা শুনে কেমন মনমরা হয়ে গেল।
-- এই যে জেদী বর।
-- অ্যাঁ।
-- হিহিহি, এই নামটা ধরে ডাকলে রাগ করবেন?
-- আমি বুঝি জেদি?
-- না, আস্ত মিনমিন্না শয়তান।
-- তবেরে!
বলেই স্মানূরের হাতটা পিছনের দিকে বাকিয়ে বলল,
-- আর বলবে মিনমিন্না শয়তান মুটি?
-- হাতটা ছাড়ুন।
-- ছাড়বোনা। আর বলবা?
-- হাতটা ধরতে হলে সারাজীবনের জন্য ধরতে হবে।
ঈশান হাতটা ছেড়ে দিয়ে অন্যপাশে সরে গেল। স্মানূর কান্নাচোখে ছুটে পালিয়ে গেল।
ঈশান ডাকতে গিয়েও ডাকল না। বুঝতে পারছেনা কি করা উচিত ওর।
পর্ব : ০৮
স্মানূর আজ ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়েছে। শর্ট জিন্স আর টপস। এসব ও কখনো পড়েনি। খুব অস্বস্থি লাগছে।
গ্রামে যাওয়ার আগে ঈশিকা কিনে দিয়েছিল আর বলেছিল, ভাইয়া বিদেশের কালচার ফলো করেছে এতদিন।
আর ভাইয়া যে মেয়েটাকে পছন্দ করত সে ও এসব পরতো। তুমি পরে ট্রাই করতে পারো যদি ভাইয়ার ভালোলাগে।
ঈশান তার এই নতুন বেশে হয়তো খুশি হতে পারে ভেবে আজ প্রথমবার এসব পড়লো।
এমনসময় কলিংবেল বাজলো, ঈশান অফিস থেকে ফিরেছে। স্মানূর গিয়ে দরজা খুলল। ঈশান ভালো করে স্মানূরের দিকে একবার তাকিয়ে রুমে এসে বিছানায় বসে পড়ল।
স্মানূর ঈশানের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলল,
-- কি হয়েছে? ট্রায়াড লাগছে?
-- হাত সরাও। বলেই স্মানূরের হাতটা ছুড়ে সরিয়ে দিল। তারপর কঠিনকন্ঠে চোখ গরম করে বলল
-- তোমাকে না বলেছি আমার উপর অধিকার না ফলাতে। বারবার ভুলে যাও কেন আমাদের বিয়ে জাস্ট একটা নাটক। পতিতার মেয়ের সাথে কখনো বিয়ের সম্পর্কে জড়ানো যায়না।
আর এসব কি ড্রেস পড়েছো? একবারো দেখেছো কেমন লাগছে? মুটি মেয়েদের এসব সাজে মানায়না। এমন বাজে চেহারা নিয়ে স্বপ্ন দেখো ঈশানের বউ হওয়ার। একজন পতিতার মেয়ে হয়েও বড়লোকের ছেলের গলায় ঝুলতে পেরেছো বলে নিজেকে অনেক কিছু ভাবো।
-- শুনুন...
-- জাস্ট শাট আপ।অনেক জ্বালিয়েছো আমাকে। একটুখানি সিমপ্যাথি দেখিয়েছি বলে মাথায় চড়ে বসেছো।আমার বাবা কি করে পারলো তোমার মত অসহ্যকর একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে আমার লাইফটা নস্ট করতে। তোমাকে আমার সহ্য হয়না।এক্ষুণি আমার বাড়ী থেকে বের হয়ে যাও। আমি যেন আর কখনো তোমার মুখ না দেখি।
বলেই ঈশান বের হয়ে গেল রুম ছেড়ে।স্মানূর অনেকবার ডাকল কিন্তু আর পিছু তাকালো না।
ঈশান ছাদে এসে দোলনায় বসে পড়ল। ঘন্টাখানেক আগে শোনা আভ্রির কথাগুলো এখনো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
একবার চোখ বুজে সবটা মিলানোর চেষ্টা করল।
" দেখো ঈশ, ইদানিং তুমি আমাকে অনেক এভোয়েড করছো। তাও শুধুমাত্র ওই মেয়েটার জন্য। ছিহ এট লাস্ট তুমিও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। তুমি আসলেই একটা কাপুরুষ। তোমার চরিত্রের ঠিক নেই।
ওহ হ্যা, থাকবে বা কেন?
আছো তো একটা পতিতার মেয়ের সাথে!
-- আভ্রি ঠিক করে কথা বল।কাকে কি বলছো?
-- ভুল কিছু বলিনি। তুমি ওর ব্যাকগ্রাউন্ড জানো? ওর জন্য তো পাগল হয়ে আছো, জানো ওর ব্যাপারে কিছু?
ও একটা পতিতার মেয়ে। আমি খোজ নিয়েছি। সিউরলি বলছি ভুল পরিচয়ে ও তোমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছে। তুমি বলো কখন ওর ফ্যামিলি মেম্বারদের দেখেছো?
দেখার কথাও না। ও তোমাকে আর তোমার ফ্যামিলিকে ঠকাচ্ছে। প্লীজ ঈশ ওকে দূর করো। ফিরে এসো আমার কাছে।"
প্রায় ভোর হয়ে এলে ঈশান রুমে আসে। স্মানূর রুমের কোথাও নেই। সারাবাড়ীতেও ঈশান স্মানূরকে পায়না।
তবে কি সত্যি স্মানূর......
পর্ব : ০৯
ড্রয়িংরুমে মি. শাহের, ফারিয়া বেগম, ঈশান আর ঈশিকা দাঁড়িয়ে আছে।মি. শাহের নীরবতা ভেঙে কড়াগলায় ঈশানকে জিজ্ঞেস করলেন,
-- স্মানূর কেন চলে গেছে? ঈশান কিছুটা রাগীকন্ঠে বলল,
-- ওর মত মেয়ে এই বাড়ীর উপযুক্ত না তাই।
-- কি করেছে ও?
-- ও যে একটা পতিতার মেয়ে সেটা কি তুমি জানতে না? মি. শাহের এমন প্রশ্নে হতব্বিহল হয়ে গেলেন। চোখ- মুখে কিছুটা ভীতছায়া দেখা গেল। ঢক গিলে নিচুস্বরে বললেন, তোমাকে কে বলেছে?
-- তুমি জানতে কিনা সেটা বল?
-- হুম জানতাম।
-- বাবা! জেনেশুনে তুমি এমন একটা মেয়েকে ঘরে তুললে!
মা, তুমিও কি জানতে? ফারিয়া বেগম নিরুত্তর থেকে হালকা মাথা নাড়েন।
-- মা তুমিও জেনেশুনে বাবার এইসব কাজ সমর্থন করলে? কেন? মি. শাহের ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- তুই সবটা না জেনে মেয়েটা কে এইকারণে অতরাতে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলি?
-- ভুল কিছু তো করিনা। মি. শাহের রেগে বলল,
-- ঈশান! ও একটা ভালো পরিবারের মেয়ে।
-- পতিতার মেয়েরা কখনো ভালো পরিবারের মেয়ে হয়না। এই জন্য আমি কখনওই ওর পরিবারকে দেখিনি। জানতামনা ওর ব্যাপারে কিছু।
-- ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসলামের মেয়ে। খুব ছোটবেলায় ওর মা মারা যায়। যখন স্মানূর আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল,মায়ের জন্য খুব কাঁদত। আসলাম একজন সোশ্যালওয়ার্কার ছিল। সে একজন পতিতাকে নবজীবন দিতে বিয়ে করে নেয়।
আমি খুব রাগ করেছিলাম ওর এমন কাজে। ভেবেছিলাম স্মানূরের সাথে তোর বিয়ের দেওয়ার কথা টা ফিরিয়ে নেব।
কিন্তু সেই মহিলার আচরন, চলন- ব্যবহার দেখে অবাক হয়েছিলাম। নিজের মেয়ের মত স্মানূরকে ভালোবাসত।
স্মানূরের যখন ১৩বছর, তখন আসলাম সন্ত্রাসীর হাতে মারা পড়ে। স্মানূরকে সেইফে রাখার জন্য মহিলা নিজের পুরোনো জায়গায় ফিরে যায়, তখন সবাই জানে স্মানূর মহিলার আপন মেয়ে। আগের জীবনে না ফিরে সেলাইমেশিনে কাজ করে উনি স্মানূরকে মানুষ করেন।
তোদের বিয়ের কিছুমাস আগে উনি মারা যান
আর স্মানূরের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন।
কিন্তু ভুলটা আমার। আমি নিষ্পাপ মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি তোর সাথে বিয়ে দিয়ে। এখন জানিও না মেয়েটি কোথায় আছে! তুই আমাকে ক্ষমা করে দিসরে মা। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মি. শাহের।
ঈশানের বড্ড অনুশোচনা হচ্ছে। আভ্রির কথা শুনে স্মানূরকে বের করে দিয়েছে। কোথায় খুঁজবে তাকে?
এমনসময় মি. শাহের ঈশানের দরজায় নক করলেন।
-- বাবা, তুমি!
-- এই নাও তোমার পাসপোর্ট আর ভিসা পেপার। তুমি চলে যাও। তোমাকে যাতে আমি আর না দেখি এই বাসায়। যে এমন নীচ কাজ করে, সে আমার ছেলে হতে পারেনা।
আর জেনে রাখো আমি আমার সকল সম্পত্তি থেকে তোমাকে ত্যাজ্য করলাম। যত তাড়াতাড়ি পারো এইখান থেকে চলে যাও। তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করো। তোমার পথের কাটা দূর হয়েছে।
আজ থেকে তোমার পরিবারও তোমার কাছে মৃত।
কথা শেষ করে মি. শাহের বেরিয়ে গেল। ঈশান কিছু বলতে পারলনা। সত্যি তো সে তো এটার জন্য ৪ মাস স্মানূরকে অবহেলা করেছে। বড্ড অপরাধবোধ হচ্ছে।
মাঝরাতে ঈশান ছাদে বসে গিটারে টুং টাং সুর তুলছে। না সুরগুলো মন মত হচ্ছেনা। গিটার টা দোলনায় ছুড়ে ফেলে রেলিং এর কাছে এসে দাঁড়াল।
কিচ্ছু ভালোলাগছেনা ওর। পুরো বাড়িটা শূন্য লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই যে পুরো বাড়ীটাকে ভরিয়ে রাখে। কারো নূপুরের আওয়াজ শোনা যায়না,, চুড়ির রিমিঝিমি শব্দ ও আর ওকে মাতাল করেনা।
ইচ্ছে করছে স্মানূরকে শক্ত করে জড়িয়ে বলতে, এই মুটি তোমাকে ছাড়া আমি অপরিপূর্ণ।
ফোনের টোন বাজতেই ঈশান বিরক্ত হয়। রিসিভ করেনা। কিন্তু বার বার বাজতে থাকায় অনিচ্ছায় রিসিভ করে-- হ্যাঁ আভ্রি বলো।
-- তোমার বউ চলে গেছে? ঈশান রেগে উত্তর দেয়,
-- হুম, তো?
-- এইবার লন্ডন এ ব্যাক করো। তুমি এলে আমরা বিয়েটা সেরে নিব। আর হ্যাঁ ১০ লক্ষ টাকা নিয়ে এসো। খুব জাঁকজমক আয়োজন করব।
-- বাবা আমাকে তার সম্পত্তি থেকে ত্যাজ্য করেছে।
-- কি? তার মানে তুমি এখন পুরো নিঃস্ব। ওহ মাই গুডনেস!
এই ঈশ শুনো আমি তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করতে পারবনা। স্যরি বেবি, তুমি আর আমার আশা করোনা।
বাই ফরএভার। বলেই লাইন কেটে দিল। ঈশানকে কিছু বলার সুযোগ দিলনা।
ঈশান অবাক হল আভ্রির এই রুপ দেখে। আভ্রি তার টাকাকে ভালোবাসত। আর এই মেয়েটার জন্য সে ভালো মেয়েটাকে কস্ট দিয়েছে।
নিজের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে খুব।
স্মানূরই তাকে সত্যি ভালবাসত। এই ভালোবাসা সে পায়ে ঠেলে দিয়েছে। খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
এই মুটি ফিরে এসো! খুব ভোরে ঈশান বাবার রুমে ঢুকল। বাবার পা জড়িয়ে বাচ্চার মত কাঁদতে লাগল।
মি. শাহেরের ঘুম ভেঙে গেল,
-- কি হয়েছে ঈশান? এভাবে কাঁদছ কেন?
-- বাবা আমি বড্ড ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্লীজ ওকে ফিরিয়ে আনো।
-- ফিরিয়ে যে তোকে আনতে হবে।
-- কোথায় আছে ও?
-- আমি জানিনা রে! তবে আগে যেখানে থাকত সে জায়গায় খোজ করতে হবে।
ঈশান ক্লান্ত হয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে। বাবার দেওয়া সব ঠিকানায় খুঁজেছে।
কোথাও পায়নি।
হঠাৎ ঈশান লক্ষ করলো.......
শেষ পর্ব✌
একটা বাচ্চা মেয়ে ব্যস্ত রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সে বুঝল মেয়েটি হয়ত রাস্তা পার হতে পারছেনা বলে কাঁদছে। কিন্তু আশে পাশের মানুষগুলো ফিরেও তাকাচ্ছেনা মেয়েটির দিকে।সে মেয়েটির কাছে গিয়ে বলল,
-- কি হয়েছে বাবু? বাচ্চাটি আঙ্গুল ইশারা করে রাস্তার ওপারের এতিমখানাটি দেখিয়ে বলল,
-- আমি ওইখানে যাব। আমাকে রাস্তাটা পার করে দাওনা।আমার ভীষন ভয় করে।
-- আচ্ছা বাবু! আমার কোলে এসো। ঈশান মেয়েটিকে কোলে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে এতীমখানায় নিয়ে এল।
বাচ্চাটা ভেতরে ঢুকেই স্মু আন্তি বলে আনন্দে চিৎকার করতে লাগল। ঈশান চলে যেতে গিয়েও ডাকটা শুনে থমকে দাঁড়াল। পিছনে ফিরে দেখে একটা মেয়ে বের হয়ে এসে বাচ্চাটিকে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে লাগল।
-- জানো, আনতি। আমি না ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার ওপাশে চলে গিয়েছিলাম।একটা ভালো লোক আমাকে রাস্তা পার করে নিয়ে এসেছে।
ওই তো লোকটা। স্মানূর তার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দিতে যাবে এমনসময় দেখে ঈশানকে।
ঈশান খুশি হয়ে ওকে ডাকতে গেলে স্মানূর বাচ্চাটিকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঈশান অনেকবার দরজা ধাক্কাল। কিন্তু স্মানূর দরজা খুলল না।
সারারাত ঈশান এতিমখানার সামনে বসে ছিল। তার আশা ছিল স্মানূর একবারের জন্য হলেও দরজা খুলে ওর কাছে ছুটে আসবে। এলো না! সকাল বেলা কারো ধমকানিতে ঈশানের ঘুম ভাঙল। সারারাত অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখটা লেগে এল। এতিমখানার দারোয়ান তাকে এইখান থেকে সরে যেতে বলল।
-- কেন দারোয়ান ভাই?
-- হুকুম আছে।
-- হুকুমটা কি স্মানূর দিয়েছে?
-- আপনি উনাকে কি করে চিনেন?
-- নিজের বউকে চিনব না! উনি এইখানে কি করে এলেন!
-- মশকরা করেন মিয়া। আপনার বউ হইলে আপনি জানেন উনি এইখানে ক্যান! যান ভাগেন!
-- আসলে আমাদের মধ্যে একটু মন কষাকষি হয়েছে। বুঝেন ই ত স্বামী- স্ত্রীর ব্যাপার
-- ওহ! সেটা বলেন। উনি তো একজন সমাজসেবী। ৪ মাস আগে অব্দি উনি এই এতীম খানার সাথে যুক্ত ছিলেন। উনার অবর্তমানে উনার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এইটা চালাত। কিছুদিন আগে উনি ফিরে এসে আবার দায়িত্ব নেন। বলছেন তো আজীবন এটার লগেই যুক্ত থাকব।
-- তোমার ম্যাডাম একটু ডেকে দাওনা!
-- আচ্ছা দাঁড়ান একটু,আমি ডেকে আনি!
-- কি ব্যাপার ডেকেছেন কেন? ঈশান অন্যদিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিল।স্মানূরের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল,
-- এই মুটি, এত্ত অভিমান কেন তোমার?
-- কিসের অভিমান? আমার কোনো অভিমান নেই। আপনি প্লীজ চলে যান।
-- ফিরে যাবানা?
-- নাহ। আপনি আপনার আভ্রির কাছে ফিরে যান।
ঈশান এক হেচকায় স্মানূরের হাত টেনে ওকে বুকের কাছে আনলো।
এক হাতে গালটা স্পর্শ করে বলল, এই মুটি বউ ভালোবাসো নাহ?
স্মানূর অন্যদিকে মুখ করে বলল, না।
-- আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল!
স্মানূর উত্তর না দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করল। ঈশান ওর হাত ধরে গাড়ীতে নিয়ে বসাল।
তারপর চোখ অফ করে ড্রাইভ করতে লাগল
--একি করছেন কি? এটা ব্যস্ত রাস্তা। এক্সিডেন্ট হবে তো।
-- হোক। আগে তুমি বল ভালোবাসো কিনা?
-- সামলে। গাড়ি আসছে।
-- বল ভালোবাসো? স্মানূর কান্নায় ভেঙে পড়ে বল্ল,
-- হুম ভালোবাসি। গাড়ী থামান। ঈশান চোখ খুলে গাড়ী পার্কের পাশে সাইড করল। স্মানূর হন্তদন্ত হয়ে নেমে গিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসল।
দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছল।
খানিকবাদে ঈশান স্মানূরের সামনে হাটু ভেঙে বসে একটা চক্লেট আইসক্রিম বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-- এই মুটি বউ, তোমার জেদী বরটাকে তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝাল ফুচকা আর টং এর দোকানে পাশাপাশি বসে এক কাপে চা খাওয়ার সুযোগ দিবা?
কথা দিচ্ছি সব বৃষ্টিতে তোমার সাথে কাকভেজা হয়ে হাচ্চু দিতে দিতে বাসায় ফিরব।
স্মানূর খানিকটা সময় ঈশানের দিকে তাকিয়ে তার হাত থেকে আইসক্রীম টা নিয়ে বলল,
-- হুম দিব।
তবে একটা শর্তে!
-- আবার কি শর্ত😞
-- যখন তোমার গাল দুইটা টেনে টেনে লাল করে ফেলব,
তারপরও লাল হওয়া গাল টা বাড়িয়ে দিয়ে বলতে হবে,
গাল দুটো একটু টেনে টেনে দাওনা!
ঈশান তক্ষুণি গালটা বাড়িয়ে বলল,
-- আস্তে টেনো কিন্তু।
মাঝরাতে স্মানূর ঈশানের মাথা রেখে চাঁদ দেখছে আর আইসক্রীম খাচ্ছে। ঈশান আড়চোখে তাকিয়ে থাকায় খাওয়া অফ করে দিল।
-- এই মুটি বউ, তোমাকে ডায়েট করতে হবেনা।
খাও আর খেয়ে আরো গুলুমুলু হও।
-- আমি বুঝি মুটি?
-- নাহ, তুমি মুটি না গুলুমুলু!
স্মানূর মুক্তোঝরা হাসি হেসে ঈশানের হাত জড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
-- খুব ভালোবাসি জেদী বরটা।
-- আমিও এত্তগুলা ভালোবাসি মুটি বউটা।
--😡😡। ঈশান স্মানূরকে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
-- অনেক ভালোবাসি গুলুমুলু বউটা।😍
তাদের গুলুমুলু ভালোবাসা দেখে আকাশের চাদটা ও যেন ফিকফিক করে হেসে উঠল।
সমাপ্ত
গল্পটি কেমন আপনার কাছে লেগেছে অব্যশই কমেন্ট করে জানাবেন.. ধন্যবাদ :)
